মেদিনীপুর

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর
(সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন না মানুষটি।  ছিলেন সংসারে এক সন্ন্যাসী। ধর্ম-কর্ম, দেবতার সেবা-পূজা, দান-ধ্যান এসব নিয়েই থাকতেন। সাংসারিক বিষয়বুদ্ধি তেমন ছিল বলে মনে হয় না।

 ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথার সুবাদে, নতুন নতুন অনেক জমিদার বংশের উদ্ভব হয়েছিল এই জেলাতেও। সেইসব জমিদারের অধীনে উদ্ভব হয়েছিল ছোট-বড় আরও বহু জমিদারের। ইজারাদার, জায়গীরদার, পত্তনিদার, দর-পত্তনিদার—নানান নাম তাদের।
সবং থানা বা জুলকাপুর পরগণাতেও গড়ে উঠেছে তেমন সব জমিদার। সেকালের তেমনই এক জমিদার ছিল শ্রীরামপুর গ্রামে জানা বংশ। বাস্তুর জন্য, ৫২ বিঘা সম্পত্তি ঘিরেছিলেন গভীর গড়খাই কেটে। সেচ আর পানীয় জলের ভারি সঙ্কট সেকালে। বাগানপুকুর, রাধাকুণ্ড, দেশা আর রামদেশা—চার-চারখানা বিশাল দীঘি খুঁড়েছিলেন জমিদাররা। হাট-এর পত্তন করেছিলেন। ‘বুধবারের হাট’ নাম হয়ে গিয়েছিল হাটটির।
ইংরেজ আসবার পুরো একশ’ বছর পরের কথা। ইং ১৮৬০ সাল। বংশের কুলদেবতা ছিলেন লক্ষ্মীজনার্দন নামের শালগ্রাম শিলা। বৈষ্ণবচরণ জানা তখন জমিদারবংশের কর্তা। কুলদেবতার জন্য একটি মন্দির গড়া শুরু করেন তিনি।
রূপনারায়ণ নদীর কোলে দাসপুর। মন্দির গড়ার সেরা কারিগরদের বাস সেখানে। সেখান থেকেই জনৈক সুবল চন্দ্র জানাকে সূত্রধর হিসাবে আনিয়েছিলেন বৈষ্ণবচরণ।
পুরো দশ বছর লেগেছিল মন্দির গড়ার কাজ শেষ হতে। মন্দিরের সামনের দেওয়ালে, ৩ লাইনের একটি প্রতিষ্ঠালিপিতে লেখা আছে সেই হিসাব– “শ্রীশ্রী লোক্ষীজনার্দন জিউ আরম্ভ মাহ মাঘ সকাবদা ১৭৮২ সাল / সাঙ্গ সকাবদা ১৭৯২ সাল বাঙ্গালা সন ১২৭৮ সাল শ্রীরাম … / পদে অভিলাষ মিস্ত্রী সিতল প্রসাদ চন্দ সাকিন দাসপুর পর …”।
মন্দির চালু হোল। পূজার বহর বেড়ে গেল তার কারণে। তখন পুরোহিত, কুমোর, মালাকার, দাসি ইত্যাদি কর্মী বহাল করেন বৈষ্ণব চরণ। জায়গির জমি দিয়ে দিলেন কর্মীদের সবাইকে।
নিজের বাকী জমি যা রইল, সব লিখে দিয়েছিলেন দেবতার নামে। বারো মাসে তেরো পার্বণের ঢল নামল তাতে মন্দিরে। বিপুল আড়ম্বরে আয়োজন হোত উৎসবগুলির।
সর্বনাশ এল এর একশ’ বছর পরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক দশকের মধ্যে, এক আইনে, জমিদারি ব্যবস্থাটাই উঠে গেল বাংলা থেকে। সেই আইনে দেবতার নামে থাকা সমূহ সম্পত্তি সরকারে খাস হয়ে যায়। নৈবেদ্যের বাতাসাটুকু কিনবার উপস্বত্ত্বটুকুও থাকেনি জানাবংশের।
সেই সঙ্কটের কালে, একে একে সরে পড়েছে কর্মীগণও। জায়গির জমিগুলিও সাথে নিয়ে গেছে সবাই। পুরোহিত মশাই গোপনে দেবতার বিগ্রহটিও নিয়ে পালিয়েছেন।
সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে মন্দিরটির সঙ্কট। গর্ভগৃহে বিগ্রহ নাই। সেবাপূজা বন্ধ। একটু একটু করে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করছিল বিগ্রহহীন মন্দিরটিতে।
বাস্তুর ভিতরে মন্দির। তাতে দিনে একবার অন্তত শঙ্খ-ঘন্টা বাজবে না, প্রণত হওয়া যাবে না দেবতার চরণে– এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল জানাবংশের। ইন্দুবালা নামে বংশেরই এক বিধবা মহিলা এগিয়ে এসেছিলেন। পূজার্চনা চালু করেছিলেন মন্দিরে।
গর্ভগৃহটির দেওয়ালে দু’দিকে দুটি মূর্তি গড়েছিলেন মন্দিরের কারিগর। শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী চতুর্ভূজ নারায়ণ মূর্তি। সেই মূর্তিতেই পূজা শুরু হয়েছিল। আজ চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে সেই পূজাটি বহাল আছে মন্দিরে। এমন দৃষ্টান্ত সারা জেলায় নাই।
ইন্দুবালা দেবী ৩৫ বছর পূজা করেছেন। তাঁর প্রয়াণের পর, গত পাঁচ বছর সেবাইত বংশের আর এক সদস্য কৃষ্ণপ্রসাদ পূজাতে যুক্ত আছেন।
বেশ উঁচু ভিত্তিবেদী ছিল মন্দিরটির। চতুষ্কোণ খোপ কাটা ছিল সেগুলিতে। দক্ষিণমুখী পঞ্চ-রত্ন মন্দিরটি ইটের তৈরি। সামনের অলিন্দে তিনটি দ্বারপথ। গর্ভগৃহে একটিই দ্বার। এই মন্দিরে স্তম্ভ বা থামগুলি ইমারতি-রীতির এবং দরুণ-রীতির খিলান। একটি সিঁড়ি আছে গর্ভগৃহের বায়ু কোণ থেকে।
অলিন্দটির সিলিং হয়েছে টানা-খিলান করে। গর্ভগৃহের সিলিং হিসাবে দুই স্তর খিলানের পর, গম্বুজ রচিত হয়েছে। উপরের পাঁচটি রত্নেই কলিঙ্গশৈলীতে রথবিন্যাস করা। শীর্ষগুলি সবই বিধ্বস্ত, সেগুলি আর দেখা যায় না।
অলঙ্করণের কিছু কাজ করা হয়েছিল। টেরাকোটার ফলক বিন্যাস আছে ছোট ছোট খোপে। বিষ্ণুর দশাবতার, সেনানি, চামরধারিনী, বাদিকা, কৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা, মকরমুখ ইত্যাদির মোটিফ সেগুলিতে। পঙ্খের উন্নত নকশার কাজও হয়েছিল। কিছু এখনও দেখা যায়।
স্টাকো-রীতিতে দুটি নারায়ণ মূর্তি গড়া হয়েছিল। গর্ভগৃহে ঢোকার দ্বারপথের দু’পাশে। সেগুলিতেই পূজার্চনার কাজ করে চলেছেন জানা বংশ।
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী কৃষ্ণপ্রসাদ জানা, গৌরহরি জানা, বনমালী জানা, কৌশিক জানা, বিশ্বজিত জানা—শ্রীরামপুর।
সমীক্ষাসঙ্গী—শ্রী প্রদীপ রাউত—ভাটবাড়, তেমাথানি।
পথনির্দেশঃ বালিচক স্টেশন থেকে তেমাথানি। সেখান থেকে সবংগামী পথে, কিমি দুই দূরে বেলতলা-সৎসঙ্গ স্টপেজ। এবার আড়াই কিমি পূর্বে শ্রীরামপুর গ্রাম ও জানাবংশের মন্দির।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ সীতারাম মন্দির, শ্রীধরপুর (দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)রূপনারায়ণ, শিলাবতী আর কংসাবতী—মুখ্য তিনটি…

1 year ago