Sunday, April 28, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮
চিন্ময় দাশ
শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর
(কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পূর্বে দুটি প্রাচীন নগর_- চন্দ্রকোণা আর খড়ার। অনেকগুলি করে প্রাচীন মন্দিরের সমাবেশ দুটি নগরীতেই। একই শিরোপার অধিকারী জেলার দক্ষিণে অবস্থিত কেশিয়াড়ি নগরীও। প্রাচীন এই নগরীটিও মন্দিরমালায় সাজানো।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বৃটিশ শাসকদের হাতে মেদিনীপুরকে জেলা শহর হিসাবে ঘোষণার পর, জেলা আদালত গড়ে তোলা হয়েছিল মেদিনীপুরে। জনৈক রামগোবিন্দ নন্দী ‘পার্সী উকিল’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। ওকালতির উপার্জন থেকে, একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। মেদিনীপুর শহরে কয়েকটি মন্দিরও গড়েছিলেন রামগোবিন্দ।
জেলা আদালতের আর একজন উকিলও বেশ খ্যাতনামা হয়েছিলেন। তিনি হলেন কেশিয়াড়ির অধিবাসী হরনারায়ণ দত্ত। নিজের উপার্জনে, তিনিও একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেকালের কেশিয়াড়ি গঠিত হয়েছিল অনেকগুলি মৌজা নিয়ে। তার ভিতর একটি হোল হাসিমপুর। জনৈক সাধুচরণ দত্ত সেখানে দত্তবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাধুচরণের পৌত্র বা গঙ্গানারায়ণের পুত্র ছিলেন হরনারায়ণ।
জেলা আদালতের উকিল হিসাবে, খ্যাতি এবং লক্ষ্মীলাভ—দুইই ঘটেছিল হরনারায়ণের। নিজের উপার্জিত অর্থে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে, এবং কিছু সম্পত্তি ইজারা বা বন্দোবস্ত নিয়ে, তাঁর জমিদারিটি ছিল বড় মাপের। এতটাই বড়মাপের যে, দু’-দুটি কাছারি গড়তে হয়েছিল তাঁকে। এখনও বড়কাছারি আর ছোটকাছারির কথা শোনা যায় প্রবীনদের মুখে।
জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে, বিশাল এক চকমিলানো অট্টালিকা গড়েছিলেন তিনি। তিনমহলা সেই অট্টলিকার অধিকাংশই আজ জীর্ণতার শিকার। উঁচু উঁচু কয়েকটি জোড়া থাম টিকে আছে কেবল। আজও সেগুলিই হরনারায়ণের ঐশ্বর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সম্পদ ভোগ করতেও জানতেন হরনারায়ণ। অট্টালিকার সাথে, একটি বাইজীবাড়িও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। সেকালে, এটি না থাকলে, জমিদারের মান থাকতো না যে!
হরনারায়ণের অক্ষয় কীর্তি কুলদেবতা দামোদর জীউর মন্দির নির্মাণ। কেশিয়াড়ির অদূরে, রোহিণীগড়। সেখানের রাজকুমার রসিকানন্দ গোস্বামী কৃষ্ণপ্রেমে মজে, বৈষ্ণব কুলতিলক শ্যামানন্দ প্রভুর সহযোগী হয়েছিলেন। এই দুই সাধক পুরুষের প্রচেষ্টায় মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশের অযুত সংখক সাধারণ মানুষ গৌড়ীয় বেষ্ণবধর্মে অবগাহন করেছিলেন।
বৈষ্ণবধর্মে আশ্রয় নিয়েছিলেন জেলার প্রায় সমস্ত রাজা জমিদারও। হরনারায়ণ দত্তও সেই ভাবস্রোতে অবগাহন করেছিলেন। কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণুকে। মন্দির গড়ে ‘দামোদর’ নামের নারায়ণ শিলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হরনারায়ণের বংশধরগণ আজও পূজার ধারাটি বজায় রেখেছেন। বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন মন্দিরটিকেও।
পরিবার বেড়েছে দত্তবংশের। তাই বলে পূজার আড়ম্বরে ঘাটতি হয়নি। দিবসে পঞ্চব্যঞ্জনের উপচারে অন্নভোগ সহ নিত্য চারবার পূজা। জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, ঝুলন, অন্নকূট, দোল, মকর, নবান্ন সহ বারো মাসে তেরো পার্বণের আয়োজন হয় ঘটা করেই।
ভক্তেরাও পূজা নিয়ে আসেন প্রায় দিনই। মানসিকের পূজায় দেবতাকে “অমৃতকুণ্ড” নিবেদন করে যান তাঁরা।
দামোদরজীউর মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। উঁচু পাদপীঠ। ইটের তৈরি, পঞ্চ-রত্ন রীতিতে নির্মিত। সামনে খিলানের তিনটি দ্বারপথ যুক্ত অলিন্দ। থামগুলি গোলাকার গুচ্ছ। খিলানগুলি দু’পরতে ভাগ করা দরুণ-রীতির।
গর্ভগৃহটিতে সামনে ছাড়া, পশ্চিমদিকেও একটি দ্বার আছে। গর্ভগৃহে দেবতার বেদীটি বেশ উঁচু ও অলঙ্কৃত। দেবতামণ্ডলীর অধিষ্ঠান একটি দারু-সিংহাসনে। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে। অলিন্দে টানা-খিলানের সিলিং।
মন্দিরের ছাউনি গড়ানো চালা-রীতির। ফলে কার্ণিশের বঙ্কিম ভাবটি, সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের মতো মনোরম।
রত্নগুলিতে কলিঙ্গ স্থাপত্যধারায় রথবিন্যাস করা। কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চরথ। কোণের রত্নগুলিতে ত্রিরথ বিন্যাস। শীর্ষক বা চুড়ায় বড় মাপের আমলক, তিন-চারটি করে কলস এবং চক্রদণ্ড।
তেমন কোন অলঙ্করণ নাই এই মন্দিরে। কার্ণিশের নীচে, কিংবা দেওয়ালের দু’দিকের কোণাচ অংশের গায়ে, ছোট ছোট খোপ কাটা প্যানেল থাকলেও, সেগুলিতে মূর্তি রচনা করা হয়নি। তবে, পশ্চিমের দেওয়ালে, অর্ধোন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে প্রিয়জনের প্রতীক্ষারত, একটি দ্বারবর্তিনী মূর্তি রচিত আছে। আর, পূর্বদিকের দেওয়ালে দুটি প্রতিকৃতি দ্বারপথও গড়া হয়েছে। একটি দ্বার ভিনিশীয় রীতির।
সব শেষে একটি পরিতোষের কথা, সম্প্রতি দামোদরের এই মন্দিরটি সংস্কার করেছেন সেবাইত বংশ। আয়ু বৃদ্ধি হয়েছে মন্দিরসৌধটির। ভারি শুভ কর্ম।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রীমতী জ্যোৎস্না দত্ত, শ্রীমতী নমিতা দত্ত, শ্রীমতী রাধারানি দত্ত। শ্রী প্রশান্ত দত্ত—হাসিমপুর, কেশিয়াড়ি।
সহযোগিতাঃ কুমারী মৈত্রী দত্ত, শ্রী দেবব্রত দত্ত—হাসিমপুর, কেশিয়াড়ি।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর বা খড়গপুর শহর থেকে ভসরাঘাটগামী পথের উপরেই কেশিয়াড়ি। এছাড়া, খড়গপুর বালেশ্বর রুটের বেলদা থেকে কিমি ১৩ পশ্চিমে কেশিয়াড়ি। বাস রাস্তা থেকে সামান্য দূরে দত্তবংশের বসবাস এবং এই মন্দির।

- Advertisement -
Latest news
Related news