
নিজস্ব সংবাদদাতা: এবছরও বন্যায় গ্রামের এক তৃতীয়াংশ ডুবেছিল বন্যার জলে, যাকে বলে ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর অনেকটা ঠিক তেমনটাই। গ্রাম থেকে ৪কিলোমিটার দুরে একটা রেলস্টেশন আছে বটে কিন্তু সব লোকাল ট্রেনও সেখানে দাঁড়ায় তেমনটা নয়। দক্ষিণপূর্ব রেলের খড়গপুর-হাওড়া শাখায় যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁরা জানবেন সেই স্টেশনটির নাম, ভোগপুর। আর মেছেদা হলদিয়া ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের রামতারক বাসস্টপেজে আসতে হলে ৮কিলোমিটার পথ ভাঙতে হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের এমনই এক প্রত্যন্ত গ্রাম কোলাঘাট থানার চাকদহ, যেখানকার এক পাতি বাংলা মিডিয়ামের ছেলে শেখ ইজাজুর রহমান চাকরি পেয়েছেন বাৎসরিক ১কোটি ২০লক্ষ টাকার অর্থাৎ মাস গেলে ১০লক্ষ টাকা!
পড়া এখনও শেষ হয়নি ইজাজুরের। আইআইটি খড়গপুরের (IIT Kharagpur)ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডুয়াল ডিগ্রি কোর্সের ছাত্র ইজাজুরের পড়া শেষ হবে এপ্রিলে আরও কয়েকমাস লাগবে ডিগ্রি হাতে পেতে। কিন্তু তার আগেই জুন মাসেই গুরগাঁওয়ের একটি শেয়ার ট্রেডিং সংস্থায় জয়েন করবে ইজাজুর। ইজাজুর সহ আইআইটি খড়গপুরের ৭পড়ুয়াকে বার্ষিক ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা বেতনে নিয়োগ করেছে ওই কোম্পানি। এরা প্রত্যেকেই সফটওয়্যার ডেভেলপার পদে চাকরি পেয়েছেন। যা ইজাজুরের জীবনে রেকর্ড তো বটেই রেকর্ড আইআইটি খড়গপুরেরও (IIT Kharagpur)।
২২বছর পেরিয়ে ২৩শে পা রাখতে যাওয়া শেখ ইজাজুর রহমান পড়াশুনা শুরু করেছেন পাশের গ্রাম চাঁইপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা শেখ ওয়াসেফউর রহমান তখন ওই স্কুলের শিক্ষক। ছেলেকে নিজের স্কুলেই ভর্তি করে নেন। ক্লাশ ফোর অবধি সেখানে পড়ার পর ইজাজুরকে ক্লাশ ফাইভে ভর্তি করে দেন পাশের গ্রামের দেড়িয়াচক শ্রী অরবিন্দ বিদ্যা মঠ হাইস্কুলে।
ক্লাশ এইট অবধি এখানেই পড়াশুনা। এরপর ইজাজুরের কাকা তমলুক হ্যামিল্টন হাইস্কুলের গণিতের শিক্ষক মিজানুর রহমান তাকে নিজের কাছে হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে রাখেন। ২০১৭ সালে সেখান থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। আর ওই বছরই জয়েন্ট এন্ট্রান্স (JEE) ক্র্যাক করে ভারতের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম আইআইটি খড়গপুরে পড়ার সুযোগ করে নেন। তারপর অবশ্য আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
ইজাজুরের বাবা শেখ ওয়াসেফউর রহমান যিনি বর্তমানে পাঁশকুড়া দক্ষিণ চক্রের কামিনাচক হরিচরণ ১নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি জানান, ‘পুরোপুরি বাংলা মাধ্যম এবং সরকারি স্কুলে পড়া আমার বড় ছেলে ইজাজুর। আমার ছোট ছেলে শাহিনুরও বাংলা সরকারি মাধ্যম থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে NEET প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইজাজুর আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার আগে যে কোচিং নিয়েছিল তাও একটি মফস্বলের কোচিং সেন্টার। তমলুক শহরের রাইজার কোচিং সেন্টার থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মা আনোয়ারা বেগম একজন সাধারন গৃহবধূ। সাধারণ কিন্তু ছেলের সাফল্যে এক অসাধারন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মা বলেছেন, ‘এই গ্রামের মাটিতেই যত মনিমুক্ত ছড়িয়ে আছে, কুড়িয়ে নিতে জানলেই মহামূল্য গহনা হয়ে যায়। এই বাংলার স্কুল, কলেজ আর শিক্ষকদের আমার প্রণাম। তাঁরা না থাকলে ইজাজুর আজ এতদূর এগুতে পারতনা।’ কোনও অহংকার নেই, উছ্বলতা নেই রহমান পরিবারের। বাংলার ঘরে ঘরে আরও হাজার ইজাজুরের অপেক্ষায় তাঁরা।
আর ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার চাকরি পেয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের চাকদহ গ্রামের ইজাজুর বলে, ‘‘ পড়ার জন্য পড়িনি, পড়েছি জানার জন্য। বাবা, মা আর কাকা এই জানার আনন্দটা প্রথম থেকেই মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে আইআইটির শিক্ষকরা সব্বাইকে পেয়েছি এই জানার কাজে। আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি সমস্ত শিক্ষকই উজাড় করে দিতে চান, হয়ত আমরা নিতে পারিনা। আমি সৌভাগ্যবান যে আমার পরিবার আমাকে এই নিতে শিখিয়ে ছিলেন। কী চাকরি পেয়েছি, কত টাকার চাকরি পেয়েছি এখন এটা একটা বড় ব্যাপার হয়েছে। কম টাকার চাকরি পেলে এসব হইচই হতনা কিন্তু আমার কাছে তার চেয়েও বড় আমি এই দুনিয়ার রহস্যের কতটা জানতে পেরেছি, আরও কত জানার বাকি!’