Monday, March 25, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩
চিন্ময় দাশ


সীতারাম মন্দির, শ্রীধরপুর
(দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)রূপনারায়ণ, শিলাবতী আর কংসাবতী—মুখ্য তিনটি নদীর জল্ধারায় উর্বর হয়েছে দাসপুর থানার ভূভাগ। তার সুবাদে, বহু পূর্বকাল থেকে, কৃষিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই থানা।

পরে, রেশম শিল্পের প্রভূত বিকাশ হয়েছিল এই এলাকা জুড়ে। তার কারণে, অর্থনীতি পুষ্ট হয়েছিল এখানে। বহু ধনাঢ্য ব্যক্তির উদ্ভব ঘটেছিল, সেকালের চেতুয়া পরগ্ণা জুড়ে।  অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিক থেকে মন্দির প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করেছিল এই ধনী পরিবারগুলির হাতে।
চেতুয়া পরগ্ণা বা বর্তমানের দাসপুর থানার ছোট একটি গ্রাম শ্রীধরপুরেও দুটি জমিদার বংশের উদ্ভব হয়েছিল। সেসময় বাংলার সমাজ জীবনে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের গভীর প্রভাব। জমিদার সামন্তবংশ ভগবান বিষ্ণুকে আরাধ্য করেন। একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কুলদেবতা রঘুনাথ-এর জন্য।
গ্রামের আর এক জমিদার ছিলেন বেরাবংশ। তাঁরাও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের বহমান স্রোতে অবগাহন করেছিলেন। সীতারাম নামিত একটি শালগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি মন্দির গড়েছিলেন তাঁরাও।
বহুকাল যাবত বেরাবংশের আর কোন অস্তিত্ব নাই এই গ্রামে। তাঁরা অন্যত্র উঠে গিয়েছেন, না কি, বংশধারাটিই অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে—সেসংবাদও এখন আর কারও জানা নাই। শূন্য প্রান্তরে, তাঁদের পরিত্যক্ত দেবালয়টিই টিকে আছে কেবল।
সাড়ে ১৪ ফুট দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের বর্গাকার মন্দির। মাথার উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট উঁচু। ফুট দুয়েক উঁচু ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, ইটের মন্দিরটি চুন-সুরকির মর্টারে গাঁথা। দক্ষিণমুখী মন্দিরসৌধটি পঞ্চ-রত্ন রীতিতে নির্মিত হয়েছে।
সামনে খিলানের তিন-দুয়ারি একটি অলিন্দ। তিনটি দ্বারপথের কেন্দ্রীয় দ্বারটি, অন্য দুটি অপেক্ষা, কিছু বড় করে নির্মিত হয়েছে। অলিন্দের সিলিং নির্মিত হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। অলিন্দের পিছনে, গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে দুই প্রস্থ খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে।
মাথায় পাঁচটি রত্নেই রথ বিভাজন করা। কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চ-রথ এবং কোণেরগুলিতে ত্রি-রথ বিভাজন। রত্নগুলির কোনটিরই চুড়া টিকে নাই। সবই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।
মন্দিরটির অলঙ্করণ হয়েছে টেরাকোটা এবং পঙ্খের ব্যবহার করে। মন্দিরে টেরাকোটার ব্যবহার হয়– মুখ্যত তিনটি দ্বারপথের মাথায় বড় প্রস্থগুলিতে, কার্ণিশের নীচ বরাবর এক বা একাধিক সারিতে এবং দুই কোণাচ অংশের খাড়া সারিতে।
এই মন্দিরে টেরাকোটার ব্যবহার হয়েছে, একেবারে দেখা যায় না, এমন বিরল একটি রীতিতে। দ্বারগুলির মাথায় নয়, কোণাচ অংশেও নয়। কার্ণিশের নীচে, টানা একটি প্যানেলে, ফলকগুলি সাজানো। ব্লক ভাগ না করে, টানা প্যানেল।
এই মন্দিরের কার্ণিশটি সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখি পল্লবের মতো মনোরম। সেই কার্ণিশের নীচে, সমান্তরাল একটি সারিতে, বড় মাপের মূর্তিগুলি রচিত। বিষ্ণুর দশাবতারের মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ মূর্তি। অন্যতম অবতার হিসাবে, জগন্নাথদেবও আছেন। সুরাপায়ী ঘোড়সওয়ার, উদ্ভিন্নযৌবনা কয়েকজন গোপিনী পরিবৃত ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় শ্রীকৃষ্ণ। গোপিনীগণের কারও হাতে কমন্ডলু, কারও চামর, কারওবা খঞ্জনী। একটি লোলচর্মা মুক্তবক্ষা বৃদ্ধার মূর্তি। গোবৎস সহ ব্রজের রাখাল। হনুমানাদি পরিবৃত সিংহাসনে আসীন রামচন্দ্র ও সীতাদেবী।
সবগুলিই বড় মাপের মূর্তি। পৃথক প্যানেল বা ব্লক ভাগ না করে, একটিই প্যানেলে, মূর্তিগুলি ক্রমান্বয়ে সাজানো। সারা জেলায় ফলকের এমন সমাবেশ বুঝি আর কোথাও নাই।
একটি রাসমঞ্চও আছে সীতারামের, মন্দিরের সামনের  প্রাঙ্গনে। নব-রত্ন মঞ্চ। রত্নগুলি বেহারিরসুন রীতির। আটটি দ্বারপথের দু’দিকে, বাদ্যযন্ত্র সহ মোট ষোলটি গোপিনীমূর্তি রচিত হয়েছিল। কিন্তু পরিত্যক্ত এবং দীর্ঘকাল অব্যবহৃত মঞ্চের একটি মূর্তিও আজ আর অক্ষত নাই।
সীতারাম মন্দিরের সামান্য পূর্বে, শিব পুকুরের পাড়ে, শিখর-দেউল রীতির ছোট আকারের একটি শিবমন্দির এবং তুলসিমঞ্চও গড়া হয়েছিল। বর্তমানে সেগুলিরও ভারি জীর্ণ দশা।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী সমীর সামন্ত—শ্রীধরপুর।
পথনির্দেশঃ পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে ঘাটালগামী পথের বেলতলা স্টপেজ। সেখান থেকে পূর্বমুখে, কিমি তিনেক দূরে,  শ্রীধরপুর গ্রাম। গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়, নির্জন একটি শূণ্য প্রান্তরে, প্রতিদিন মৃত্যুর প্রহর গুণছে পরিত্যক্ত মন্দিরটি।

- Advertisement -
Latest news
Related news