শিল্প সাহিত্য

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর
(চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ, কেতুবংশ ইত্যাদি এখানে রাজত্ব করে গিয়েছে। তাদের হাতে বহুতর উন্নতি ঘটেছে এই নগরীর।

একেবারে শেষ পর্বে এই নগরীর সমৃদ্ধি ঘটেছিল বয়নশিল্প থেকে। পাট এবং সূতি বস্ত্রের বয়ন ছিল পূর্বকাল থেকে। পরবর্তী কালে রেশমশিল্পের বিকাশ হয় এই নগরীতে। রেশমশিল্পের টানে, বিদেশী বণিকের দল এখানে এসে হাজির হয়েছি্‌ সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। একে একে, ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান, ফরাসিরা এসে হাজির হয়েছিল।
অবশেষে, বেনিয়া ইংরেজরা এসে মঞ্চে হাজির হয়। অন্যদের তাড়িয়ে, রেশমের পুরো ব্যবসা কুক্ষিগত করে নেয় তারা। তবে, রেশমশিল্পের প্রভূত বিকাশ হয়েছিল ইংরেজদের হাতেই।
শিল্পের বিকাশের সুবাদে, নতুন নতুন অনেক বৃত্তিধারী ব্যক্তি আর পরিবারের উদ্ভব হয়েছিল চন্দ্রকোণায়। রেশম উৎপাদনের জন্য তুঁতচাষে দক্ষ মুসলমান পরিবার, বুননের কাজে দক্ষ তন্তুবায় সম্প্রদায়, মজুতদার, মহাজন, দালাল-ফড়ে, ব্যবসায়ী—কে ছিল না?
রেশম ব্যবসার সুবাদে বিকশিত হয়েছিল চন্দ্রকোণার সামগ্রিক অর্থনীতিও। তার ফলে, উদয় হয়েছিল সোনা-রূপার কারিগর স্বর্ণবণিক, দেবসেবার গন্ধদ্রব্য নির্মাতা গন্ধবণিক, শোলাশিল্পের দক্ষ কারিগর মালাকার, কর্মকার, কুম্ভকাররাও।
এঁদের সাথে, বিশেষ করে যাদের কথা বলা প্রয়োজন, তাঁরা হলেন মন্দির নির্মাণ এবং কাঠখোদাই কাজের কারিগর সূত্রধর সমাজ। কেবল চন্দ্রকোনা নগরী নয়, সমগ্র ঘাটাল মহকুমা জুড়ে অজস্র মন্দির গড়ে উঠেছিল এঁদের হাতেই।
যাইহোক, রেশমশিল্পের বিকাশের ফলে, চন্দ্রকোণা নগরীর বেশ কিছু পরিবার ধনী হয়ে উঠেছিল। অগণন দেবমন্দির গড়ে তুলেছিল সেই ধনী পরিবারগুলি।
সমগ্র দক্ষিণ বাংলা জুড়ে তখন মহাপ্রভূ চৈতন্যদেবের প্রচারিত প্রেমধর্মের গভীর প্রভাব। বৈষ্ণবীয় রীতিতে আরাধনার জন্য, এই  নগরীতে মঠ, আশ্রম, মন্দির গড়ে উঠেছে অনেকগুলিই। সেসবের ভিতরে ছোট হলেও, একটি শিবমন্দির গড়ে উঠেছিল নতুন করে। আজকের আখ্যান সেই শিবালয়টিকে নিয়ে।
চন্দ্রকোণা নগরীর গা-লাগোয়া দুটি মহল্লা– নরহরিপুর আর মিত্রসেনপুর। শিবমন্দিরটি গড়া হয়েছিল এই দুইয়ের প্রায় সীমানায়। পূর্বকাল থেকে নরহরিপুরের ‘রামানন্দী লস্করীয় মঠ’ বা ‘ছোট অস্থল’-এ ছিল একটি বিষ্ণু মন্দির ছিল। একটি বিষ্ণুমন্দির ছিল পাশের মিত্রসেনপুর মহল্লাতেও। সেখানে জনৈক সীতারাম কর, ‘অনন্তদেব’ নামে শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্দিরে।
এই দুই মন্দিরের মাঝামাঝি এলাকায়, নরহরিপুর মহল্লায়, একটি পঞ্চ-রত্ন মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল। স্থানীয় তাম্বুলী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। ৫ সারিতে লেখা একটি প্রতিষ্ঠা-লিপিও ছিল মন্দিরে— “শ্রীকলকলী দেবীপদং ধ্যাত্বা যত্নতঃ। / তস্যা গৃহমিদং ভক্তৈস্তাম্বুলিনিকরৈঃ কৃতং / প্রতিষ্ঠিতমিদং শাকে পদ্মাব্ধবসু চন্দ্রমে / রাধাক্ষয় তৃতীয়ায়াংদত্তমানে কুব্জবাসরে সন / ১২৯৭ ১০ই বৈশাখ”।
অর্থাৎ ১২৮২ শকাব্দে, বাংলা ১২৯৭ সনের ১০ই বৈশাখ বা ইং ১৮৯০ সালে কলকলি দেবীর এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিনজন দেবদেবীর বিগ্রহ ছিল মন্দিরে। তিনটিই পাথরের মুণ্ডমূর্তি। দুটি কূর্মমূর্তি। অন্যটির নাম ছিল কলকলি দেবী। বলা হয়, দেবী কালিকার সাথে মূর্তিটির সামঞ্জস্য ছিল, সেকারণে এমন নামকরণ। ‘কলকলি দেবীর মন্দির’ নামেই পরিচিত ছিল মন্দিরটি। তবে, দেবীর পূজা হয় ‘লোকদেবী শীতলা’ হিসাবে।
অপরদিকে, মিত্রসেনপুরে করবংশে বিষ্ণুমন্দির থাকলেও, শিবপূজনের কোন সুবিধা ছিল না। পুররমণীদের চাহিদায়, সেইবংশে সীতারাম-এর পুত্র কালাচাঁদ কর, কলকলিদেবীর মন্দিরের সামান্য তফাতে, এই শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীকালে দেবীর মন্দিরটি নষ্ট হয়ে গেলে, এলাকার অধিবাসীদের অনুরোধে, মন্দিরের তিনটি মূর্তি শিবের মন্দিরের এনে স্থাপন করা হয়েছে।
বর্তমানে শিবমন্দিরে ৪টি মূর্তি স্থাপিত। উজ্বল কালোরঙের বড়মাপের শিবলিঙ্গ। বাকি তিনটি পাথরের মুখমণ্ড্‌ তিনটি মাটির ঘটের উপরে স্থাপিত।
প্রতিষ্ঠাতা কালাচাঁদ করের পুত্র ছিলেন গৌরচন্দ্র। তাঁর দুই পুত্র—জীবন কৃষ্ণ (অকৃতদার), নিমাই চরণ। নিমাই চরণের তিনজন সন্তান—শতাব্দী, ইন্দ্রানী এবং সর্বজিৎ। এঁরাই দেবতার বর্তমান সেবাইত।
মন্দিরে চারজন দেবদেবীরই নিত্য আরাধনা করা হয়। এছাড়া, শিব চতুর্দশী পালিত হয় ঘটা করে। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার কলকলি দেবীর বিগ্রহে বিশেষ পূজা হয়।
তবে, শেষ মঙ্গলবারের পূজাটি হয় বেশ জাঁকজমকের সাথে। এলাকাবাসীগণই আয়োজন করেন বড় আকারের সেই পূজার। মন্দিরটি পারিবারিক। কিন্তু পূজাটি হয় সর্বজনীন আকারেই।
শিবের এই মন্দিরটি পূর্বমুখী। ইটের তৈরি আট-চালা মন্দির। ৯ ফুট দৈর্ঘ-প্রস্থের সৌধটির উচ্চতা ফুট পঁচিশেক। খিলানের একটি ছোট মাপের দ্বারপথ। গর্ভগৃহে সিলিং হয়েছে চাপা-খিলানের উপর গম্বুজ রচনা করে। মন্দিরের কার্ণিশের বঙ্কিমরেখাটি, সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের মতো, মনোরম দর্শন।
টেরাকোটা ফলকে সাজানো মন্দির —বিষ্ণুর দশাবতার, ইঁদুর-বাহন গণেশ, শ্রীকৃষ্ণ, গরুড়-বাহন বিষ্ণু, ঢাকবাদনরত ঢাকি, ভাঙ প্রস্তুতকারী গুরুর চেলা ইত্যাদি ফলক– ছোট ছোট খোপে সাজানো। আছে বড় মাপের দুটি দ্বারপাল মূর্তিও।
এছাড়া, জ্যামিতিক প্যাটার্ণে ফুলকারি নক্সার কাজ করা পঙ্খের কারুকাজ আছে সৌধটিতে। তবে, সবই ভারি জীর্ণতার শিকার।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী জীবন কৃষ্ণ কর, শ্রী নিমাই চরণ কর, শ্রী সর্বজিৎ কর। শ্রীমতী শতাব্দী কর আশ, কুমারী ইন্দ্রানী কর।
সমীক্ষাসঙ্গী—শ্রী রামপ্রসাদ পাঁজা, ভূমি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী– জয়ন্তীপুর, চন্দ্রকোণা শহর।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর, খড়গপুর, পাঁশকুড়া, চন্দ্রকোণা রোড কিংবা আরামবাগ—সব দিক থেকেই সরাসরি চন্দ্রকোণা পৌঁছানো যাবে। বাসস্ট্যাণ্ড থেকে অল্প দূরেই মিত্রসেনপুর।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ সীতারাম মন্দির, শ্রীধরপুর (দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)রূপনারায়ণ, শিলাবতী আর কংসাবতী—মুখ্য তিনটি…

12 months ago