Wednesday, May 22, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১৮২।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল                                                                         চিন্ময় দাশকালাচাঁদ মন্দির, চিলকিগড়
(জামবনি, ঝাড়গ্রাম)
ওডিশায় পুরীর গজপতি বংশের রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের শাসনকাল ইং ১৪৯৭ থেকে ১৫৪০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রথম জীবনে তিনি জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব দীক্ষা এবং সন্ন্যাস গ্রহণের পর, নীলাচলে এলেন যখন, তখন প্রতাপরুদ্র দেবের শাসনকাল। চৈতন্যদেবের প্রভাবে প্রবল প্রতাপান্বিত এই রাজা বৈষ্ণবধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। রাজা এবং তাঁর মন্ত্রী রামানন্দ রায়ের তৎপরতায়, বৈষ্ণব ধর্ম ওডিশার প্রধান ধর্মে পরিণত হয়েছিল।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

যাক, সেসব অন্য এবং অনেক কথা। মেদিনীপুর জেলা কেবল ওডিশা রাজ্যের সীমানা লাগোয়া, তাই নয়। প্রতাপরুদ্র দেবের সময়ে, মেদিনীপুর জেলার সিংভাগ এলাকা তাঁর অধিকারে ছিল। রাজা তাঁর এক সহপাঠী এবং সুহৃদ, জনৈক বলভদ্র ত্রিপাঠীকে, জামবনি পরগনার জমিদারি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাহাড়ি নদী ডুলুংয়ের ঘন জঙ্গলের ভিতর, একটি গড় নির্মাণ করেছিলেন বলভদ্র। তাঁর ‘ত্রিপাঠী’ পদবি থেকে, গড়ের নাম হয়েছিল– টিহারীদ্বীপা গড় বা টিহারী গড়। পরে, সেই নাম চিলকিগড় হিসাবে খ্যাত হয়েছে।বলভদ্রের বংশের এক উত্তরপুরুষ, নিঃসন্তান বিশ্বরূপ ত্রিপাঠীর মৃত্যুর পর, তাঁর সেনাপতি গোপীনাথ মত্তগজ সিংহ রাজা হয়েছিলেন। তিনিই দেবী কনকদুর্গার মন্দির স্থাপন করেছিলেন। অপুত্রক গোপীনাথের মৃত্যুর পর, তাঁর দৌহিত্র কমলাকান্ত ধবলদেব ঘাটশিলা থেকে এসে রাজা হয়েছিলেন। তিনিই টিহারিগড় থেকে ডুলুং নদীর পশ্চিমে রাজধানী তুলে এনেছিলেন। সুউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা অট্টালিকা গড়ে, তার প্রাঙ্গণের ভিতর, শিব এবং কালাচাঁদের এই মন্দির তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। কনকদুর্গা মন্দিরে শাক্তমতে সেবাপূজার বিঘ্ন ঘটাননি। কিন্তু কালাচাঁদের মন্দিরে সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় ধারায় সেবাপূজার প্রচলন করেছিলেন কমলাকান্ত। সেই ধারা আজও প্রবহমান।
কালাচাঁদ এবং রাধারানী ছাড়াও, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার দারুবিগ্রহ, এবং ২৭টি শালগ্রাম বা বিষ্ণুশিলাও মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা। আজও তাঁরা মন্দিরে পূজিত হন। দিনে পঞ্চব্যঞ্জন সহ অন্নভোগ আর রাতে পরমান্নের নৈবেদ্যে নিত্য পূজা প্রচলিত আছে। পূর্বের রাজকীয় আড়ম্বর না থাকলেও, সম্বৎসরে বারো মাসে তেরো পার্বনের আয়োজন আজও হয়।
জগন্নাথদেব আছেন মন্দিরে। সেকারণে, শয়ন-পার্শ্ব-উত্থান– ৩টি একাদশী পালন তো আছেই। রথযাত্রা এবং পুনর্যাত্রারও আয়োজন হয় এখানে। তবে, এখানে কালাচাঁদের রথ আষাঢ়ে নয়, কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
কালাচাঁদের পূর্বমুখী মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে পঞ্চরত্ন রীতিতে। যদিও, পুরাবিদ তারাপদ সাঁতরা এই মন্দিরকে “স্থাপত্যবৈশিষ্টে অভিনব” বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ হল, মন্দিরটির নিচের তল বা গর্ভগৃহটি দালান-রীতিতে নির্মিত। সেটির মাথায় কোনো দ্বিতল নির্মাণ না করে, সমতল ছাউনির উপরেই ৯টি রত্ন স্থাপন করা হয়েছে। মূল মন্দিরের চার কোণে চারটি, গর্ভগৃহের মাথা বরাবর চার কোণে একটি করে চারটি এবং কেন্দ্রীয় ভাগে একটি– এই ন’টি রত্ন-বিন্যাস। এমন নিদর্শন বড় একটা দেখা যায় না।
গর্ভগৃহ এবং অলিন্দ নিয়ে এই মন্দির। একটি নয়, চার দিকেই চারটি অলিন্দ গর্ভগৃহকে বেষ্টন করে আছে। প্রতিদিকেই খিলানের তিনটি করে দ্বারপথ। গর্ভগৃহের একটিই দ্বার।
উপরের ন’টি রত্নই একই সমতলে স্থাপিত। রত্নগুলির গড়ন প্রচলিত স্থাপত্যশৈলীকে অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। একেবারে কোণের চারটি রত্ন, ভিতরের ছোট চারটি রত্ন এবং কেন্দ্রীয় রত্নটি– পৃথক পৃথক তিনটি গড়নে রচিত হয়েছে। কোণের রত্নগুলিতে দ্বারপথ এবং ভিতরে শুন্য গর্ভগৃহ রচিত হয়েছে। অবশিষ্ট পাঁচটিতে প্রতিকৃতি দ্বার দেখা যায়, গর্ভগৃহ নাই। রত্নগুলির শীর্ষক বা চূড়ার গড়নও প্রচলিত শৈলীকে অনুসরণ করেনি। ছবি থেকে স্পষ্ট অনুভব করা যাবে। তেমন কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। অলিন্দের মুখ্য দ্বারপথের মাথায় শ্রীকৃষ্ণের একটি মুরলীধর-মূর্তি, গর্ভগৃহের দরজার মাথায় একটি লম্বোদর-মূর্তি এবং উপরে কেন্দ্রীয় রত্নের প্রতিকৃতি-দ্বারের উপর একটি গরুড়-মূর্তি– এইমাত্র। সবগুলি মূর্তিই পৃষ্ঠভূমি থেকে উদ্গত করে, ‘বা-রিলিফ রীতি’তে রচিত হয়েছে।
অলিন্দের দুই কোনাচ অংশে খাড়াভাবে দু’সারি খোপ কাটা থাকলেও, কোনো ফলক লাগানো বা মূর্তি রচনা করা হয়নি।
সাক্ষাৎকার () : রাজমাতা শ্রীমতী কৃষ্ণাকুমারী দেবী, শ্রী বিজয়েশদেও মলদেব– চিলকিগড়। উভয়েই বর্তমানে প্রয়াত। শ্রী অচিন্ত মুখার্জি– চিলকিগড়।
পথ-নির্দেশ : কলকাতা, খড়্গপুর, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, টাটা– যেকোনও দিক থেকে, বাস কিংবা ট্রেনযোগে, ঝাড়গ্রাম। সেখান থেকে সবরকম গাড়ি চিলকিগড় যাতায়াত করে। রাজবাড়ির প্রাঙ্গণের ভিতর কালাচাঁদ মন্দির ছাড়াও, মূল ফটকের গায়ে সুউচ্চ শিখরযুক্ত শিবমন্দিরটিও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এছাড়া, পাহাড়ি নদী ডুলুং পার হয়ে, বনভূমির আঁচলে ঘেরা দেবী কনকদুর্গার মন্দির সফর– স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকবে অনেক দিন।

- Advertisement -
Latest news
Related news