Wednesday, May 22, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ১৮০।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশঅনন্তদেব মন্দির
(মিত্রসেনপুর,চন্দ্রকোণা শহর)মান্য ইতিহাসে দেখা যায়, ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে, ক্রমান্বয়ে মল্লবংশ, কেতু বংশ, ভান বংশ, এবং সব শেষে বর্ধমান রাজ বংশের শাসনে ছিল চন্দ্রকোণা। কারও কারও অভিমত, কেতুবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রকেতু-র নাম থেকে চন্দ্রকোণা নামের উৎপত্তি।
অপরদিকে, ভানবংশের শেষ রাজা ছিলেন মিত্রসেন। তাঁর নাম থেকে মিত্রসেনপুর নামে একটি গ্রাম গড়ে উঠেছিল। ১৮২৮ সালে ইংরেজের হাতে চন্দ্রকোণা পৌরসভা হিসাবে গড়ে উঠলে, মিত্রসেনপুর একটি ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘বাহান্ন বাজার আর তিয়ান্ন গলি’-র শহর চন্দ্রকোণা। এই শহর এক সময় সূতি, পাট এবং রেশম বস্ত্রের উৎপাদনে বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। তার সাথে বিকশিত হয়েছিল নানান কুটিরশিল্পও। এই সকল শিল্পসম্ভার বিকাশের সুবাদে, ইউরোপীয় বণিকরা যেমন লাভবান হয়েছিল, তেমনই ভাবে ধনবান হয়ে উঠেছিল স্থানীয় বহু পরিবারও। এই পরিবারগুলির মধ্যে তাম্বুলি, সুবর্ণ বণিক এবং তন্তুবায়রা ছিল অগ্রগণ্য। চন্দ্রকোণা নগরীর বহুসংখ্যক মন্দির এই তিন সম্প্রদায়ের হাতে নির্মিত।
বহু পূর্বকাল থেকে মিত্রসেনপুর এলাকাটি একটি সমৃদ্ধ পটি বা মহল্লা হিসাবে পরিচিত। এই পটির বামুনপাড়ায় শরাক (বুদ্ধ উপাসক শ্রাবক) তন্তুবায় সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কেবল মিত্রসেনপুর মহল্লায় নয়, চন্দ্রকোণা পৌর এলাকার ১০টি মহল্লায় শরাক সম্প্রদায় বসবাস করেন।
যাইহোক, এই জার্ণালের আলোচ্য মন্দিরটি মিত্রসেনপুর এলাকায় অবস্থিত। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলক থেকে জানা যায়, ১৭০২ শকাব্দে, বঙ্গাব্দের ১১৮৭ সনে বা ইং ১৭৮০ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক শ্রী নিমাই চরণ দাস দত্ত।
একটি সংস্কার-ফলকও আছে দেওয়ালে। তা থেকে জানা যায়, ১৮২১ শকাব্দে, বঙ্গাব্দের ১৩০৬ সনে বা ইং ১৮৯৯ সালে, জনৈক শ্রী কালাচাঁদ কর মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন।
সংস্কার কাজের কিছুকাল পরেই, মন্দিরের বিগ্রহটি চুরি হয়ে যায়। তখন থেকে বিগ্রহহীন দেবালয়টি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।
দেবী লক্ষ্মীর একটি বিগ্রহ করবংশের বসতবাড়িতে রেখে পূজার্চনা করা হয়। কালাচাঁদ করের দুই পৌত্র শ্রী জীবনকৃষ্ণ কর এবং শ্রী নিমাই চরণ কর সেবাইত হিসাবে বহাল আছেন।
খোপ কাটা, ফুট তিনেক উঁচ্‌ পাদপীঠ। তার উপর পূর্বমুখী ইটের মন্দিরটি দালান-রীতির। বর্গাকার মন্দিরের দুটি অংশ—সামনে খিলানের তিন-দুয়ারী অলিন্দ। সিলিং হয়েছে টানা-খিলানের সাহায্যে। পিছনে খিলানেরই এক-দুয়ারী গর্ভগৃহ। তার সিলিংও খিলানে গড়া হয়েছে। মন্দিরের সামনের আলসে-র উপর রচিত, শীর্ষক বা চুড়া অংশটি ভারি সুদর্শন। লম্ফমান দুটি সিংহমূর্তি আরও মহনীয় করেছে সেটিকে। মাঝখানের শীর্ষক অংশটি বেঁকি, আমলক, কলস, বিষ্ণুচক্র শোভিত।
মন্দিরের অলঙ্করণ হয়েছে টেরাকোটা আর পঙ্খের সমাহারে। কার্ণিশের নীচে সমান্তরাল এক সারি এবং দুই কোণাচের গায়ে দুটি খাড়া সারিতে ছোট ছোট খোপে কিছু ফলক যুক্ত করা হয়েছে।
ফলকের মোটিফ হিসাবে দেখা যায়, রাধাকৃষ্ণ, বিষ্ণুর দশাবতার, রামচন্দ্র ও সীতাদেবীর সিংহাসন আরোহন, বাদ্যযন্ত্র সহ সংকীর্তন-দৃশ্য ইত্যাদি।
পঙ্খের কাজ আছে সামনের দেওয়ালে। তিনটি দ্বারপথের মাথার উপর, তিনটি বড় প্রস্থে, পঙ্খের জ্যামিতিক নকশা আছে। কিছু মূর্তিও রচিত হয়েছে এই মন্দিরে। ১ কার্ণিশের উপরে, আলসে-র কেন্দ্রীয় অংশে, ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান, বড় আকারের একটি কৃষ্ণমূর্তি। ২ শীর্ষক বা চুড়ার দু’দিকে, ব্যাদিত-বদন দুটি লম্ফমান সিংহমূর্তি। ৩ গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’দিকে দুটি দ্বারপাল মূর্তি।
মন্দিরটি দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত। বিলম্বিত লয়ে হলেও, জীর্ণতার ছাপ ফুটে উঠছে সারা অঙ্গে। এখনই সতর্ক না হলে, সঙ্কটের সৃষ্টি হবে প্রাচীন সৌধটির।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী জীবনকৃষ্ণ কর—মিত্রসেনপুর।
সহযোগিতাঃ শ্রী গণেশ দাস, প্রাবন্ধিক—ঠাকুরবাড়ি, চন্দ্রকোণা শহর।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর, খড়গপুর, পাঁশকুড়া, চন্দ্রকোণা রোড কিংবা আরামবাগ—সব দিক থেকেই সরাসরি চন্দ্রকোণা পৌঁছানো যাবে। বাসস্ট্যাণ্ড থেকে অল্প দূরেই মিত্রসেনপুর।

- Advertisement -
Latest news
Related news