Tuesday, May 21, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল—১৭৮ ।।চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশরঘুনাথ মন্দির, আমোদপুর- ভট্টাচার্য্যবংশ
(ডেবরা, পশ্চিম মেদিনীপুর)চিরপ্রবাহিনী কংসাবতী। পুরুলিয়া জেলার জাবরবন পাহাড়ে (থানা ঝালদা) উৎপত্তি এ নদীর। বাঁকুড়া হয়ে, মেদিনীপুরে তার প্রবেশ।
তিন জেলাতেই, এ নদীর ডাইনে-বাঁয়ের অববাহিকা জুড়ে, জৈনধর্মের বিকাশ হয়েছিল এক সময়। অনেক মন্দির গড়ে উঠেছিল জৈন সম্প্রদায়ের হাতে। সেগুলির কয়েকটি মন্দির এখনও টিকে আছে। তবে, এসব হাজার বছর পূর্বকালের কথা।
একেবারে আধুনিক কালে, হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে, বহু দেবালয় গড়ে উঠেছিল, কংসবতীর দুকূল জুড়ে। এই জেলায়, মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে, নদীর উত্তর কূলে মেদিনীপুর কোতওয়ালি আর কেশপুর; দক্ষিণে খড়গপুর আর ডেবরা—এই চারটি থানায় মন্দির অগণন। মুখ্যত মোগল শাসনকালের শেষপর্ব থেকে ইংরেজ শাসনের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মন্দিরগুলি।
ডেবরা থানার ছোট একটি গ্রাম আমোদপুর। শ’পাঁচেক বিঘাও নয় এর আয়তন। পূর্বকালে সাহাপুর পরগণার অন্তর্ভুক্ত এই এলাকা নাড়াজোল রাজবংশের অধীন ছিল। বেশ কয়েকজন পত্তনিদার ছিলেন নাড়াজোল রাজাদের।
পরবর্তীকালে, ইংরেজের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথার সুবাদে, পত্তনিদারদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে, তিনটি জমিদার ও ভূস্বামী বংশের উদ্ভব হয়েছিল এই গ্রামে। জানা পদবীর মাহিষ্য, পাল পদবীর সদগোপ এবং ভট্ট পদবীর ব্রাহ্মণ—তিন সম্প্রদায়ভুক্ত তিনটি বংশ। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা সকলেই।
ভট্টবংশের আট-প্রজন্মের বংশলতিকা পেয়েছি আমরা। তা থেকে জানা যায়, জনৈক নীলকন্ঠ ভট্ট ইং ১৮১৯ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নীলকন্ঠের একমাত্র পুত্র—গৌরাঙ্গ। তাঁর একমাত্র পুত্র ভূবন মোহন ভট্ট।ভূবন মোহনের দুই পুত্র—রামনারায়ণ এবং শ্যামচরণ। চতুর্থ প্রজন্মে পৌঁছে, এই দুই সহোদর ‘কৌলিক পদবী ‘ভট্ট’ পরিবর্তন করে, ‘ভট্টাচার্য্য’ হয়েছিলেন। তাঁদের বংশধরগণ ভট্টাচার্য্য পদবীই ব্যবহার করে আসছেন। সকলেই দেবতার সেবাপূজার সাথে যুক্ত।
মন্দিরটি জীর্ণ হলেও, রঘুনাথ নামিত শালগ্রাম শিলাটি এখনও মন্দিরেই বিরাজিত আছেন। নিত্য আরাধনাও হয় দেবতার। পূর্বের আড়ম্বর না থাকলেও, আছে বারো মাসে তেরো পার্বনের আয়োজনও। এই মন্দিরে, সেসবের ভিতর, জন্মাষ্টমী এবং রাস পূর্ণিমা প্রধান।
ইটের পূর্বমুখী মন্দিরটি পঞ্চ-রত্ন রীতির। ইং ১৮১৯ সালে নির্মিত সৌধটির ২০০ বছর আয়ুষ্কাল পূর্ণ হয়েছে। সুদীর্ঘ কালের আঘাতে মন্দিরের ভিত্তিবেদীর সম্পূর্ণ অংশই ভূমিগত হয়ে গিয়েছে। তবে, মন্দিরকে বেষ্টন করে একটি প্রদক্ষিণ-পথ ছিল, তার ইঙ্গিতটি দেখা যায় কেবল।সামনে খিলান-রীতির তিন-দুয়ারী একটি অলিন্দ ছিল। সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কোনও রকমে টিকে আছে পিছনের এক-দ্বারী গর্ভগৃহটি। মাথায় চালা-ছাউনি। চালার জোড়মুখগুলি ‘বিষ্ণুপুরী’-রীতির।
উপরের পাঁচটি রত্নের দুটি সম্পূর্ণ অবলুপ্ত। অবশিষ্ট তিনটিরও ভারি জীর্ণ দশা। দেউল-রীতির রত্নগুলিতে বাঢ়-বরণ্ড-গণ্ডী– তিন অংশ জুড়ে রথ-বিন্যাস করা এবং গণ্ডী অংশে পীঢ়-রীতিতে ভূমির সমান্তরালে সরলরৈখিক থাক কাটা।
শীর্ষক অংশগুলি প্রায় বিলীন। দেখাই যায় না প্রায়। স্থানচ্যুত একটি মাত্র আমলক লেন্সে ধরা পড়েছে। সেটিতে কলিঙ্গশৈলীর ছাপ বেশ স্পষ্ট। বহিরঙ্গে বা অভ্যন্তরের পলেস্তারা প্রায় নাই। যে সামান্য কিছু টিকে আছে, তা থেকে বোঝা যায়, মসৃণ পঙ্খের প্রলেপে মোড়া ছিল মন্দিরের সর্বাঙ্গ।
সামনের দেওয়ালটি আর টিকে নাই। তবে, পূর্ববর্তী পুরাবিদগণের বিবরণ থেকে জানা যায়, টেরাকোটার কিছু অলঙ্করণ ছিল সেই দেওয়ালে। ফলক বিন্যাস করা ছিল কার্ণিশের নীচে এক সারি এবং দুই কোণাচ অংশের গায়ে দুটি খাড়া সারিতে। বিষ্ণুর দশাবতার, শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলাদৃশ্য ইত্যাদি রূপায়িত ছিল তিনটি প্যানেলে।একটি মাত্র টেরাকোটা ফলক এখনও টিকে আছে এই মন্দিরে। দক্ষিণের দেওয়ালে, কার্ণিশের নীচে। মোটিফ—এক নারী কর্তৃক পুরুষের মুখে প্রস্রাব করার দৃশ্য। বিশেষ উল্লেখের বিষয় হোল, এই একই ফলক, মেদিনীপুর জেলার, বিশেষত পূর্ব এলাকার অনেক মন্দিরে দেখা যায়।
বড় বড় গাছপালার শেকড় শত বাহুর বেষ্টনিতে বেঁধে রেখেছে জীর্ণ দেবালয়টিকে। তবে, আয়ু যে আর বেশিকাল নয়, একথা বলবার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের সকলের চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি ঐতিহ্য সম্পদ!
সাক্ষাতকারঃ শ্রী শ্রীজীব ভট্টাচার্য্য—আমোদপুর।
পথ-নির্দেশঃ খড়্গপুরের দিক থেকে মুম্বাই রোডের উপর বসন্তপুর। সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব মুখে, কিমি সাতেক দূরে আমোদপুর গ্রাম।

- Advertisement -
Latest news
Related news