Monday, May 20, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৩০।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল—১৩০
                                       চিন্ময় দাশ
লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, অমর্ষি কশবা (পটাশপুর)

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

আরবি ‘কসবাহ’ শব্দ থেকে ‘কশবা’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে, এমনটাই বলা হয়। ‘কশবা’ শব্দটির অর্থ হোল—শহরের চেয়ে ছোট, আবার গ্রামের চেয়ে বড়, কোনও সমৃদ্ধ গঞ্জ বা গণ্ডগ্রাম। কোন স্থানের মূল নামটির আগে কিংবা পরে, পূর্বপদ বা অন্তপদ হিসাবে, কশবা শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে। মেদিনীপুর জেলায় কশবা নারায়ণগড়, কশবা এগরা, সবং কশবা ইত্যাদি নাম তার উদাহরণ।
কাঁথি মহকুমার এমনই আর একটি প্রাচীন জনপদ—অমর্ষি কশবা। অতীতে এই এলাকার এক খ্যাতিমান হিন্দু নৃপতি ছিলেন জনৈক অমর সিংহ। তাঁর রাজধানি ছিল অমর্ষিতে। অমর সিংহের নাম থেকেই ‘অমর্ষি’ নামের উদ্ভব— ঐতিহাসিকগণের তেমনটাই অভিমত।

এক সময় খ্যাতনামা এক পীর ছিলেন এখানে। সকল ঐতিহাসিকের বিবরণে সেই পীর খাজা মখদুম সিহাবুদ্দিন চিস্তি এবং তাঁর মাজার ও তিন-গম্বুজ মসজিদের বিবরণ পাওয়া যায়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের কথা, অমর্ষি কশবা গ্রামেরই পুরাকীর্তি হিসাবে, অন্তত ৩০০ বছরের প্রাচীন, একটি মন্দিরের উল্লেখ কোথাও দেখা যায় না। সেই জীর্ণ পরিত্যক্ত মন্দিরটির সালতামামি আমাদের এবারের এই জার্ণালে।
মেদিনীপুর জেলার একমাত্র মুসলমান শাসক ছিলেন, জেলার সর্ব দক্ষিণে সমুদ্র তীরবর্তী হিজলী রাজ্যের জমিদার তাজ খাঁ ‘মসনদ-ই-আলা’। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, গুরুদেব মখদুম সাহেবের আদেশে, তিনি অমর সিংহের কাছ থেকে, অমর্ষি রাজ্যটি অধিকার করে নিয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দশকে, ১৫৯৪ সালে, যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য হিজলী অধিকার করে নিলে, সেই অভিঘাতে অমর্ষিও হিজলীর জমিদার বংশের হাতছাড়া হয়ে যায়। সেসময় অমর্ষি রাজ্যটি কয়েকটি ছোট ছোট মহালে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একটি বড় অংশে বাল্যগোবিন্দপুরে রায়চৌধুরী বংশ, পালপাড়া এলাকায় মহাপাত্র (যদু মহাপাত্র) বংশ প্রমুখ নতুন জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তেমনই ছোট একটি জমিদারী গড়ে উঠেছিল অমর্ষি এলাকাতেও। জমিদার রায়বংশের বসতি ছিল অমর্ষি কশবা (জে এল নং ১৩৪) গ্রামে। বসতবাড়ির সাথে কুলদেবতার জন্য একটি মন্দিরও গড়েছিলেন জমিদাররা।

বলা হয়, পটাশপুর থানা মহাপ্রভু চৈতণ্যদেবের পদধুলিধন্য। জগন্নাথধাম পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে, কেলেঘাই নদীর পাথরঘাটায় নৌকা থেকে নেমে, পদব্রজে এই থানার উপর দিয়েই, তিনি রেমুনা অভিমুখে রওণা হয়েছিলেন । তার ফলশ্রুতিতে বৈষ্ণবীয় প্রেমধর্মের বন্যা বয়ে গিয়েছিল সারা থানা জুড়ে। ঘরে ঘরে ভগবান বিষ্ণু বা রাধাকৃষ্ণের আরাধনা প্রচলিত হয়েছিল।
জমিদার রায়বংশও সেই পথের অনুসারী হয়েছিল। কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল বিষ্ণুকে। লক্ষ্মীনারায়ণ নামিত শালগ্রাম শিলাকে কুলদেবতা হিসাবে গ্রহণ করে, বসতবাড়ির সাথেই মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল দেবতার জন্য।
জানা যায়, এক বার স্থানীয়ভাবে হিন্দু-মুসলমান বিবাদের সময়, নিরাপত্তার প্রয়োজনে মন্দির থেকে শালগ্রাম বিগ্রহটি সরিয়ে নিতে হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী পঁচেটগড় জমিদারবাড়ীর কুলদেবতা শ্রীশ্রীকিশোররায় জীউর মন্দিরে রেখে আসা হয়েছিল বিগ্রহকে। সেখানেই আজও বিগ্রহটি পূজিত হয়ে চলেছেন।

সেই ডামাডোলের সময় কেবল বিগ্রহ স্থানান্তরিত হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। জমিদার রায়বংশও সেসময়েই অমর্ষি এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। সেসময় তাঁদের এই মন্দির, সংলগ্ন বাস্তু এলাকা ইত্যাদি তাঁরা স্থানীয় অধিবাসী জনৈক দীননাথ চন্দ্রকে হস্তান্তর করে দিয়ে যান। দীননাথের উত্তরপুরুষগণই বর্তমানে সেসকলের স্বত্ত্বাধিকারী।
যেদিন দেবতা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মন্দির থেকে, সেদিন থেকেই পরিত্যক্ত শূণ্য মন্দিরটি অনাদর আর অবহেলার শিকার। কালের করাল ছোবল তার সর্বাঙ্গে। ধীরে ধীরে নোনা হাওয়া, আর মানুষের অত্যাচারে, ভারি করুণ দশা দেবালয়টির।
যে গর্ভগৃহে দেবতার আসন পাতা হয়েছিল, কাঁসর-ঘন্টায় দেবতার পদবন্দনা হত যেখানে, সেটিতে আজ আবর্জনার ডাঁই। গৃহপালিত গবাদি পশুর গোয়ালঘর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গর্ভগৃহের মেঝেতে পোঁতা চারটি খুঁটিও দেখেছি আমরা। হায়, আমাদের পোড়া কপাল!

পূর্বমুখী ইটের দেবালয়টি নির্মিত হয়েছিল আট-চালা হিসাবে। এখনও ফুট আড়াই উচ্চতা আছে মন্দিরের ভিত্তিবেদীটির। পলেস্তারা বহুপূর্বেই উধাও হয়ে গিয়েছে। গোলাকার থামের কঙ্কালগুলির মাথায় দেখা যায়, খিলানগুলি ‘দরুণ-রীতি’তে রচিত হয়েছিল। তিন খিলানের অলিন্দের সিলিং হয়েছিল ‘টানা-খিলান’ রীতির। পিছনে একদ্বারী গর্ভগৃহ। সেটির সিলিং হয়েছে খিলানের উপর গম্বুজ রচনা করে।
আট-চালা মন্দির। উপর এবং নীচ—দুটি তলেরই ছাউনির চালগুলি দেওয়ালের সাথে চাপা। বড় আকারের কার্ণিশগুলির বঙ্কিম ভাব বেশ সুদর্শন। অলঙ্করণ হিসাবে স্টাকোর কারুকাজ ছিল, তার কিছু চিহ্ন দেখা যায়।
শীর্ষক বা চুড়া অংশটি বহুকাল পূর্বেই বিলীন হয়ে গিয়েছে। বেঁকি, আমলক, কলস, চক্র ইত্যাদি কিছুই আর অবশিষ্ট নাই।

জমিদার নাই। দেবতার বিগ্রহ নাই। কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজ নাই। নাই মন্দিরের সৌন্দর্যের চিহ্নমাত্রও। যা আছে তা হোল আমাদের ঔদাসীন্য, অনাদর আর অত্যাচারের চালচিত্র। আর আছে বট-অশ্বত্থ মহীরুহের শিকড়ের বজ্রবাহুতে জড়িয়ে ধরা একটি দেবালয়ের মৃত্যুপথযাত্রার জলছবি।
কত দূর দূর দেশ পর্যটন করি আমরা। বেরিয়ে পড়ি বিখ্যাত দেবালয় দর্শনে। কিন্তু দু’পা ফেলে, বাড়ির অনতিদূরের এই জীর্ণ দেবালয়টি আজও দেখা হয়নি আমাদের অনেকেরই। এটি কম পরিতাপের কথা নয়।

সাক্ষাতকারঃ সর্বশ্রী শুকদেব চন্দ্র, সুশান্ত চন্দ্র—অমর্ষি কশবা। হরেন্দ্র নাথ মাইতি—এগরা শহর।
সমীক্ষাসঙ্গীঃ শ্রী অমলেন্দু নায়ক—মঙ্গলামাড়ো।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর-খড়গপুর থেকে কাঁথিমুখী রাস্তার এগরা হয়ে উত্তরমুখে অমর্ষি বাজার। কিংবা, কলকাতা থেকে দীঘামুখী রাস্তার বাজকুল হয়ে পশ্চিমে অমর্ষি। সেখানে গার্ল স্কুলের পিছনেই অবলুপ্তির প্রহর গুনছে জীর্ণ মন্দিরটি।

- Advertisement -
Latest news
Related news