নিজস্ব সংবাদদাতা: লড়াইটা শুরু হয়েছিল বছর আগে, এক অন্য লড়াই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘রাঁধার পর খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধা’র জীবন থেকে গৃহবধূদের বের করে আনা। রাঁধা আর খাওয়া কিংবা পরিবারের মানুষগুলোকে খাওয়ানোর বাইরেও যে গৃহবধূদের জীবন আছে, সৃষ্টি আছে আর স্বনির্ভরতার প্রয়োজন আছে, সেই সূর্যের দিকে গৃহবধূদের মুখ ফেরানো। তাঁদের সূর্যমুখী হয়ে ওঠানো।
এই ভিন্ন ভাবনা থেকেই মেদিনীপুর শহরের দুই গৃহবধূ তৈরি করেন একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম শ্রীদর্শিনী। ৭ বছর পেরিয়ে এই গ্রূপের সদস্য সংখ্যা এখন ৩০ হাজার! সদস্য আছেন ভারতের বাইরে সাগর পাড়ের ইউরোপ আমেরিকাতেও।
শ্রীদর্শিনীর অন্যতম কর্মকর্ত্রী নম্রতা ঘোষ জানান, ‘কলেজে পড়ার সময় থেকেই ঘুরতাম বিভিন্ন একজিবেশন, মেলায়। আর ভাবতাম এরকম একটা মেলা যদি আমার হত? আমার আরও একটা শখ কিংবা ঈর্ষাও বলতে পারেন, সেটা হল আমি যা পরব, সেটা শাড়ি কিংবা সালোয়ার, গহনা সেটা শুধু আমিই পরব। এর দ্বিতীয় কোনও নমুনা বাজারে থাকবেনা। এখন এই যে ইউনিক কিছু এটা কেবলমাত্র হ্যান্ডম্যাডই সম্ভব। আর তা করতে গেলে অনেকের প্রয়োজন হবে। এই ভাবনা থেকেই কিছু একটা করার ভাবনা শুরু হয়েছিল। এরপর সঙ্গী হিসাবে পেয়ে গেলাম অনিন্দিতাকে। দুজনে মিলে দুর্গাপুরে একটা প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে শুরু করলাম। সেই শুরু। এরপর এক এক করে বাড়তে বাড়তে আমরা এই জায়গায় দাঁড়িয়েছি। ভাবনা আছে আরও নতুন নতুন কিছু করার।’
কোভিড কালের আগে পর্যন্ত নম্রতা, অনিন্দিতারা ঠিক মেলা পার্টির মতই মাসে একবার দল বেঁধে নিজেদের ‘একজিবেশন কাম সেল’ নিয়ে ছুটেছে বাঁকুড়া, তমলুক, দুর্গাপুর, আসানসোল, ঘাটাল, তমলুক, বিষ্ণুপুর, হলদিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায়। সংস্থার অন্যতম কর্ণধার অনিন্দিতা বোস জানিয়েছেন, ‘ যেখানেই আমরা এই ধরনের একজিবেশন নিয়ে গেছি সেখানে আমরা যেমন আমাদের পণ্যের ক্রেতা পেয়েছি তেমনই পেয়েছি সেই সমস্ত গৃহবধূর সন্ধান যাঁদের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টি মন আর কিছু একটা করার অদম্য ইচ্ছা। এইভাবে আমরা আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়েছি। এঁদের কেউ যেমন শাড়ি, ব্লাউজ, সালোয়ার, কুর্তির ওপর কাজ করেন তেমনই কেউ বানান গহনা কেউ আবার গৃহ সাজানোর রকমারি। কেউ বানান বিভিন্ন খাবার। এখন আমাদের সংস্থা সব ধরনের প্রোডাক্টই বিক্রি করে। করোনা কালে অনলাইন ব্যবসাতে নেমেছে শ্রীদর্শিনী। বিদেশেও পৌঁছে যাচ্ছে বাংলার গৃহবধূদের ঘরে তৈরি জিনিসপত্র।’
নম্রতা জানিয়েছেন, ‘ জয়নগরের মোয়া কিংবা জনাইয়ের মনোহরা, পিংলার পট কিংবা সবংয়ের মাদুর কাটির মত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলা শিল্পীদের ঘরে তৈরি জিনিস আমরা বিপণন করছি। দেশের বাইরেও উড়ে যাচ্ছে সেই সব পণ্য। দেশ বিদেশে তিরিশ হাজার সদস্য রয়েছে শ্রীদর্শিনীর। আমরা মাঝে মধ্যেই নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে লাইভ প্রোগ্রাম করে সেগুলিকে হাজির করি। সেখান থেকেই অর্ডার চলে আসে। এই ক’দিন আগেই আমরা এক গৃহবধূর ৫০ কিলোগ্রাম চকলেটের অর্ডার পাইয়ে দিলাম। এভাবেই কলকাতা থেকে কালনা কিংবা মেদিনীপুর থেকে মালদা ৫০০ মহিলা যুক্ত হয়েছেন আমাদের সাথে। তাঁদেরই প্রোডাক্ট আমরা অফলাইন বা অনলাইনে বিপণন করি।’
শ্রীদর্শিনীর এবারকার উইন্টার এক্সিবিশন কাম সেল
শুরু হয়েছে মেদিনীপুর শহরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাপরিষদ প্রাঙ্গনে। ৩১শে জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি শেষ হচ্ছে ৩রা ফেব্রুয়ারি, সোম থেকে বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা অবধি চলা এই প্রদর্শনীতে কলকাতা বুটিকের শাড়ি, কুর্তি ছেলেদের জামা, পাঞ্জাবী ইত্যাদিতো থাকছেই সঙ্গে থাকছে থাকবে পিংলার পটচিত্র শিল্পীরা। শাড়ি জামা কাপড়ে পছন্দ সই পটচিত্র আঁকিয়ে নেওয়ার সুযোগ। থাকছে হাতে তৈরী রকমারি চকলেট, পিঠে, প্রষিদ্ধ গহনা বড়ি, নলেন গুড়,পাটালি গুড়, নবদ্বীপ এর ক্ষীর দই, জয়নগর এর মোয়া, জনাইয়ের মনোহরা প্রভৃতি।
আপনি বলতেই পারেন, ‘ও আর এমন কী, পাটালি, নলেন, জয়নগরের মোয়া ঢের খেয়েছি।’ কিন্তু না, শ্রীদর্শিনীর এই প্রদর্শনী থেকে কিনে নিয়ে খাবার পরই আপনার মনে হবে, আগে কখনই খাননি আসল পাটালি কিংবা মোয়া। মনে হবে এই প্রথম খেলেন। আর শুধু কিনতেই নয়, আপনিও যদি এমন কিছু করতে চান তবে এই প্রদর্শনীতে গিয়ে যোগাযোগ করে ওঁদের সাথে যুক্ত হয়ে যেতে পারেন। আপনার দ্রব্য অন্যের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে শ্রীদর্শিনীই। তবে শ্রীদর্শিনীর তরফে অনুরোধ জানানো হয়েছে কোভিড বিধি মেনে আসুন, মাস্ক পরে আসুন।