Wednesday, May 22, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৮৩ ।।  চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল                                                         চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগরজীউ মন্দির,          (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)
অনেক কাল আগের কথা। হাতি আর উটের কাফেলা সাজিয়ে, তীর্থ পরিক্রমায় বেরোতেন সাধু আর সন্ন্যাসীর দল। নিত্য আরাধনার জন্য, সাথে থাকত নিজের নিজের ইষ্টদেবতা।
কখনো কখনো ধর্মপ্রাণ ধনাঢ্য গৃহীও বেরোতেন। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ ক্ষেপানাথ চট্টোপাধ্যায়-এর নাম জানা যায়। মানুষটি যতটা না ধনী ছিলেন, ধর্মপ্রাণ ছিলেন তার চেয়েও বেশি। একবার তীর্থ পরিক্রমার জন্য, পথ নেমেছিলেন তিনিও।
পূর্বকালে গয়া থেকে জগন্নাথধাম পুরী পর্যন্ত একটি প্রাচীন পথ ছিল। ‘নন্দ কাপাসিয়ার জাঙ্গাল’ নামের সেই পথ ধরে, উত্তর ও মধ্য ভারতের সাধু-সন্ন্যাসী এবং বণিকের দল, দক্ষিণ্মুখে যাতায়াত করতেন। পথটি মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করেছিল গড় মান্দারণ থেকে। সেখান থেকে বেরিয়ে, চন্দ্রকোণা নগরীকে প্রায় ছুঁয়ে গিয়েছিল পথটি। এই পথে বহুবার দাক্ষিণাত্য অভিযান করেছে বাদশাহী ফৌজ। অনুমান করা যায়, ক্ষেপানাথও পরিক্রমা করছিলেন সেই পথেই।
সেসময় সারা বাংলা জুড়ে বিষ্ণু আরাধনার স্রোত বয়ে চলেছে। শ্রীচৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রচলন করেছেন। সারা বাংলা এবং বাঙালি মজেছে সেই প্রেমধর্মে। ক্ষেপানাথ চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন সেই পথের পথিক।
সেসময় চন্দ্রকোণা নগরীতে বহু মঠ আর মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল। রেশমশিল্পের সুবাদে ধনী হয়ে ওঠা ব্যক্তিরা এই নগরীর অলিতে গলিতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নগরীর ধর্মীয় পরিমণ্ডলটি মনে ধরেছিল ক্ষেপানাথের। তীর্থদর্শন সেরে, ফিরতি পথে, চন্দ্রকোণা নগরীতেই শিকড় গেড়েছিলেন তিনি। ক্ষেপানাথ যখন থিতু হলেন এখানে, পূর্বকাল থেকে, কয়েকটি ‘অস্থল’ আর ‘শ্রীপাট’ প্রতিষ্ঠিত ছিল চন্দ্রকোণায়। বড় অস্থল, ছোট অস্থল, মুড়াকাটা অস্থল ছিল। ছিল দামোদরজীউ শ্রীপাট, গোপীমোহনজীউ শ্রীপাট, আউলিয়া শ্রীপাট, বলরাম শ্রীপাট ইত্যাদি।
ক্ষেপানাথ নিজেও ‘নরোত্তম শ্রীপাট’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরিক্রমার সময়, কুলদেবতা রসিকনাগরজীউ এবং একটি রাধিকামূর্তি সাথে ছল। শ্রীপাট গড়ে, দুই দেবদেবীর পূজার প্রচলন করেছিলেন তিনি।
ক্ষেপানাথের পুত্র রাধামোহন চট্টোপাধ্যায়। কেবল ধর্মপ্রাণ নয়, বৈষ্ণবধর্মে গভীর জ্ঞানের অধিকারী দুজনেই। অচিরেই খ্যাতি প্রচারিত হয়েছিল দুই আগন্তুকের। ধর্মার্থী মানুষজন তাঁদের কাছে দীক্ষা নিতে শুরু করেন। দূর-দূরান্তরেও অনেক শিষ্য ছিল এঁদের। তখন থেকে ‘গুরুবংশ’ নামে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিল বংশটি। তাতে কৌলিক চট্টোপাধ্যায় পদবী অব্লুপ্ত হয়ে, ‘গোস্বামী’ পদবীতে পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁরা।কুলদেবতার জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্টায় উদ্যোগী হয়েছিলেন রাধামোহন। তখন অর্থবান শিষ্যকুল তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। জানা যায়, মেদিনীপুর শহরের অন্যতম ধনী জমিদার, স্বর্গীয় গঙ্গারাম দত্ত মন্দির নির্মাণের উল্লেখযোগ্য দায় বহন করেছিলেন।
ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি বেশ বড় মাপের। বর্গাকার সৌধটি নব-রত্ন রীতিতে নির্মিত। মন্দিরের চার দিকেই চারটি অলিন্দ। তবে, দক্ষিণের অলিন্দটি আবৃত। জানা যায়, গর্ভগৃহের একটি গুপ্তপথ এই অলিন্দের সাথে যুক্ত আছে। অনুমান করা যেতে পারে, অলিন্দটি হয়তো দেবতার শয়নকক্ষ হিসাবে ব্যবহার করা হোত।
বাকি তিনটি অলিন্দের প্রতিটিতেই তিনটি করে খিলানের দ্বারপথ। মন্দিরের দ্বিতলেও, চারদিকে তিনটি করে খিলানের দ্বার সহ, চারটি উন্মুক্ত অলিন্দ আছে।
দ্বিতলের একটি বৈশিষ্ট হল, সেখানে বাইরের দেওয়ালে, প্রতিটি খিলানের মাথা বরাবর, একটি করে ‘প্রতিকৃতি রত্ন’ রচিত আছে। সারা জেলায় এমন উদাহরণ আর নাই। মন্দিরের আর একটি বৈশিষ্ট হোল, উপরের পাঁচটি রত্ন চতুষ্কোণ আকারের। কিন্তু নীচতলার চারটি রত্নের গড়ন আট-কোণা বা অক্টাগোনাল। মন্দিরের অধিকাংশ রত্নই আর টিকে নাই। তবে, আমরা পৃথক গড়নের দুটি রত্নের ছবি দেখাব এখানে। মন্দিরের রত্নগুলিতে রথ-বিভাজন এবং গণ্ডী অংশে পীঢ়বিন্যাস করা হয়েছে। অলিন্দগুলিতে টানা-খিলানের সিলিং। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে দুই প্রস্থ পুরু খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে।
মন্দিরটির অলঙ্করণ হয়েছে পঙ্খ আর টেরাকোটার সাহায্যে। টেরাকোটার ফলকগুলি যুক্ত ছিল সামনের দেওয়ালে। বেশ কয়েকটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি রচিত হয়েছে পঙ্খ-এর কাজ হিসাবে। ভারি অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী মূর্তিগুলি। পঙ্খের বহু নকাশি কাজ আছে বাইরের দেওয়ালগুলিতে। তাতে নীলরঙের ব্যবহারও দেখা যায়।
পরিতাপের কথা, বহু বছর আগে, একবার ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল মন্দিরটি। সেসময় বাধ্য হয়েই দেবতার বিগ্রহ সরিয়ে নিতে হয়েছিল। তখন থেকে ছোট আকারের নতুন একটি মন্দিরে রেখে, শ্রীশ্রী রসিকনাগরজীউর সেবাপূজা প্রচলিত হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রতিদিন পলে পলে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিন গুনছে বিগ্রহহীন পরিত্যক্ত মন্দিরসৌধটি। এ বড় পরিতাপের কথা!
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী মুরারী মোহন গোস্বামী, শিবেন্দু গোস্বামী এবং দিব্যেন্দু গোস্বামী—জিরাট মুণ্ডমালা।
সমীক্ষাসঙ্গী ও সহযোগীঃ শ্রী গণেশ দাস, প্রাবন্ধিক—ঠাকুরবাড়ি, চন্দ্রকোণা শহর।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর শহর, চন্দ্রকোণা রোড স্টেশন কিংবা পাঁশকুড়া থেকে সরাসরি চন্দ্রকোণা পৌঁছানো যাবে। সেখানে চন্দ্রকোণা ঘাটাল পথের গায়েই জিরাট মুণ্ডমালা।

- Advertisement -
Latest news
Related news