নিজস্ব সংবাদদাতা: খড়গপুর চৌরঙ্গী থেকে ইন্দা কলেজের আগে অবধি কিংবা আইআইটি খড়গপুর (IIT Kharagpur) ফ্লাইওভারের সামনের ডিভাইডারের ওপর সার দিয়ে পড়ে রয়েছে গাছেদের লাশ! অধিকাংশই পাতাবাহার কিংবা ফুলের। কিন্তু এখন আর সেসব বোঝার উপায় নেই। ডাল পাতা কান্ড শুকিয়ে এখন সব একাকার, এখন সব লাশ।রোদে ঝলসে বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হতে হতে পুড়ে ছাইয়ের মত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে কিছু, কিছু এখনও কোথাও কোথাও সবুজ আভা নিয়ে হয়ত বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে। রাস্তার ওপর সেই সব গাছেদের লাশ দেখতে দেখতে বেদনায় কুঁকড়ে যান পথচারীদের কেউ কেউ। আবেদন জানান, প্রতিদিন এই জিনিস দেখতে দেখতে যাওয়া আসা করতে হয়। ভালো লাগেনা।
কথা হচ্ছিল আইআইটি খড়গপুর ক্যাম্পাসে থাকা এক অধ্যাপকের সঙ্গে। সেই অধ্যাপক জানালেন, ” এ বোধহয় আমাদের দেশে কিংবা হয়ত এই বাংলাতেই সম্ভব হয়। আর কদিন পরেই বর্ষা আসছে। বনদপ্তরের উদ্যোগে পালন করা হবে অরণ্য সপ্তাহ। ‘গাছ লাগাও, গাছ বাঁচাও’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হবে বাংলা। বনদপ্তরের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হবে গাছের চারা। আমরা গাছ বাঁচানোর মিছিলে হাঁটব, বড় বড় কথা বলব। কিন্তু দিনের শেষে কী দাঁড়ায় তারই একটা মর্মান্তিক ছবি দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন। কখনও ক্যাম্পাস থেকে গোলবাজার বা হয়ত অন্য কোথাও যাচ্ছি গাড়ি নিয়ে। আমার ছেলের বয়স সাত বছর। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, বাবা গাছ গুলোতে জল দেয়না কেন? আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনা। আমার পৌরসভার (Kharagpur Municipality) কাছে একটাই আবেদন, মরা গাছ গুলোকে সরিয়ে নিন প্লিজ।”
সেই একই বেদনা যেন ইন্দা নিউ টাউনের (Inda New Town) বাসিন্দা রুম্পা ঘোষের। রুম্পা গৃহবধূ। স্বামী খড়গপুরের একটি একটা বেসরকারি কোম্পানির এক্সিকিউটিভ অফিসার। রুম্পা জানান, শনিবার বিকালে কিংবা রবিবার একটু হয়ত আউটিংয়ে যাই। কখনও কাঁসাই নদীর পাড়ে কখনও আবার পাথরা। চৌরঙ্গী থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার জুড়ে এই গাছেদের মৃতদেহের সারি দেখতে হয়। একটা পৌরসভার পরিচালকবৃন্দ কতটা স্পর্শকাতরহীন তা এই জায়গাটা দিয়ে গেলেই অনুভব করা যায়। তাঁরা তো প্রতিদিন মেদিনীপুর খড়গপুর করেন তাঁদের কী নজরে পড়েনা সুন্দর সুন্দর গাছেদের এই পড়ে থাকা লাশগুলো? গাছগুলোকে মেরে তো নিজেদের হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন সেই মেরে ফেলা গাছেদের মৃতদেহগুলি সার দিয়ে সাজিয়ে রেখে কিসের পরিচয় দিচ্ছেন? কেন যন্ত্রনা দিচ্ছেন শহরবাসীদের?”
জানা গেছে শহরের সৌন্দর্যায়নের নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে হাজার খানেক গাছ লাগানো হয়েছিল চৌরঙ্গী থেকে ইন্দা আর আইআইটি ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে। মহার্ঘ্য টবে বসানো সেই গাছ গুলো ফেন্সিং করা হয়েছিল যাতে না গরুছাগল খেয়ে ফেলতে পারে। বড় বড় করে লেখা হয়েছিল ‘ সৌজন্যে খড়গপুর পৌরসভা।’ কিন্তু গাছেদের প্রতি নূন্যতম সৌজনের স্বাক্ষর রাখেনি পৌরসভা। জল সেচ না করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে গাছ গুলোকে। ঠিক যেমন করে একসময় মানুষকে হত্যা করে তাদের লাশ রেখে দেওয়া হত, তেমন করেই রেখে দেওয়া হয়েছে গাছেদের লাশগুলো।
চৌরঙ্গী থেকে ইন্দা এই রাস্তা জুড়ে অজস্র ছোটবড় শোরুম, হোটেল রেস্তোরাঁ, বিভিন্ন কোম্পানির বাণিজ্যিক কেন্দ্র রয়েছে। তাদের সঙ্গেও যদি পৌরসভা কোনও চুক্তি করে গাছগুলো দেখভালের ব্যবস্থা করত তাহলেও টিকে থাকতে পারত গাছগুলো। কারন ওই সমস্ত কোম্পানিগুলির অনেকেই নিজেদের সংস্থার সামনে সবুজায়ন করেছে। তেমনই এক হোটেল মালিক বলেছেন, ‘ওগুলো পৌরসভার সম্পত্তি আমরা মাথা গলাবো কী ভাবে। যদি পৌরসভা বলত তাহলে আমাদের সামনের অংশের গাছগুলো আমরাই দেখভাল করতে পারতাম।’ ওই মালিকের বক্তব্য, আসলে সৌন্দর্যায়নের নামে বেশকিছু টাকা পকেটে ঢুকল এটাই ঢের। এরপর গাছ বাঁচল না মরল কার কী যায়? গাছ না মরলে আবার গাছ লাগানো হবে কী করে?”