মেদিনীপুর

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪
চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর
(পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের জল-সীমানা। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই, রেশম শিল্পের বিকাশ হয়েছিল এই নদের পশ্চিম অববাহিকা এলাকা জুড়ে। পরে, তার সাথে যোগ হয়েছিল নীলচাষ।এই দুইয়ের সুবাদে, বেশ কিছু পরিবার অর্থবান হয়ে উঠতে পেরেছিল। ছোট বড় নানান মাপের জমিদা্রীও প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের কেউ কেউ।

সেকালের কাশীজোড়া পরগণার টিকরপাড়া গ্রাম। সে গ্রামের মান্না পদবীর একটি ধনীবংশও একটি জমিদারী গড়েছিল সেসময়।
টিকরপাড়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম মার্কণ্ডপুর। উৎকল শ্রেণীর একটি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশের বসবাস ছিল সেখানে। বংশটির আদি নিবাস ছিল প্রতিবেশী ওড়িশা রাজ্যে। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত, মেদিনীপুর জেলার প্রায় সমগ্র এলাকা উৎকলের রাজাদের শাসনে ছিল। সেসময় থেকে, ওড়িশার বিভিন্ন জীবিকার ও বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের বহু পরিবার বাংলার মেদিনীপুর জেলায় চলে এসেছিল। মার্কণ্ডপুর গ্রামের ব্রাহ্মণবংশটি তাদেরই অন্যতম।
যাইহোক, টিকরপাড়ার জমিদার, মার্কণ্ডপুরে গিয়ে একটি মন্দির গড়েছিলেন। পৌরিহিত্য সহ, মন্দিরের সমূহ দায়ভার তুলে দিয়েছিলেন ভূঞ্যাদের হাতে। সেদিন থেকেই, ভূঞ্যাবংশ মন্দিরটির সেবাইত হিসাবেও বহাল হয়েছে।
রাধাকৃষ্ণের মন্দির। দেবতার নাম—গোপীনাথ। এছাড়া, গোপাল, বৃন্দাদেবী, নারায়ণ মুর্তিও পূজিত হন। নারায়ণ নামের এক মূর্তি শালগ্রামও মন্দিরে অধিষ্ঠিত আছেন।
গোপীনাথের প্রথম পূজক বা সেবাইত নিযুক্ত হয়েছিলেন দাসমোহন ভূঞ্যা। সাত পুরুষে পৌঁছে, বর্তমানে বংশটি অনেকগুলি পরিবারে বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে পালি প্রথায় দেবতার সেবাপূজা করেন তাঁরা। রাধাপদ, নিরাপদ এবং বাবুলাল—তিন শরিকের বংশধরগ্ণ, ৪ মাস হিসাবে, পূজার অধিকারী হয়েছেন।
গোপীনাথের মন্দিরটি শিখর-দেউল রীতির। সামনের নাটমন্দিরটি সম্পূর্ণ ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে জগমোহনটিও। সেটির অবশেষ থেকে বোঝা যায়, খিলানের তিন-দুয়ারী ছিল জগমোহনটি। সিলিং ছিল টানা-খিলানের।
অন্তরালও গড়া হয়েছিল মন্দিরে। তবে, অতিশয় সংক্ষিপ্ত আকারে। মাত্রই ইঞ্চি দশেক পরিমিত। সংক্ষিপ্ত হলেও, শিখর-দেউল মন্দির নির্মাণের রীতিটি অনুসরণ করেছিলেন সূত্রধর, এটি বেশ পরিতোষের কথা।
বিমান বা গর্ভগৃহে একটিই দ্বার, খিলানের। সিলিং হয়েছে চারটি দেওয়ালের  কোণাচ অংশকে মুড়ে, মাথায় গম্বুজ রচনা করে।
জগমোহনের মাথায় ছাউনি ছিল গড়ানো চালা-রীতির। বিমানের বাইরের দেওয়ালে, পা-ভাগ, বাঢ়, বরণ্ড ও গণ্ডী—চারটি অংশ জুড়েই নব-রথ বিন্যাস করা। শীর্ষক অংশটি বর্তমানে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত—প্রলম্বিত বেঁকি, পর পর দুটি সুরচিত আমলক এবং জীর্ণ নিশানদণ্ডটিই কেবল টিকে আছে।
অলঙ্করণের তেমন কিছু এখন আর দেখা যায় না। দুটি মাত্র নমুনা টিকে আছে। একটি রচিত হয়েছে উত্তরের দেওয়ালে, রাহাপাগ অংশের উপর। স্টাকো রীতির কাজ। ফলকটিতে দেখা যায়– এক পুরুষের জন্য, বিবদমান দুই নারী। একজনের পদাঘাতে, অন্যজন ভূপাতিতা। সারা জেলায় প্রায় ছয় শত মন্দির সমীক্ষা করেও, এমন নিদর্শন আমাদের চোখে পড়েনি। জানা যায়, মন্দিরের পাদপীঠ বা ভিত্তির গায়েও, পৃথক পৃথক ব্লকে, আরও বেশ কিছু মূর্তি রচিত ছিল। যেগুলি বেশ ব্যতিক্রমী।
কিন্তু সেসকল আর টিকে নাই। শিল্পকর্মগুলি চাপা পড়ে গিয়েছে মাটির তলায়। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে তাদের রূপবৈভব। ধ্বংস হয়ে গিয়েছে মন্দিরের সামনের নাটমন্দির আর জগমোহনও। এবার পালা মূল মন্দিরটির। কালের আঁচড় পড়া শুরু হয়েও গিয়েছে। এখনই সংরক্ষণের কাজে হাত না লাগালে, টিকিয়ে রাখা যাবে না এটিকেও।
সেবাইত বংশের সাধ্য কতটুকু! মন্দিরটিকে বাঁচাতে হলে, এগিয়ে আসতে হবে সরকারি বা অসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানকে। ঐতিহ্যপ্রেমী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসবেন—সেই আশায় অপেক্ষা করে আছে সেবাইতবংশটি।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রীমতী সন্ধ্যারানি ভূঞ্যা, সর্বশ্রী ধনঞ্জয় ভূঞ্যা, রঞ্জিত কুমার ভূঞ্যা, সুধীর চন্দ্র ভূঞ্যা, দেবব্রত ভূঞ্যা, প্রণব ভূঞ্যা—মার্কণ্ডপুর।
সমীক্ষাসঙ্গী ও সহযোগিতাঃ শ্রী পার্থ দে—তমলুক।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রী ভাস্কর পতি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক—তমলুক। শ্রী রূপেশ কুমার সামন্ত, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক— পাঁশকুড়া।
পথনির্দেশঃ একটু প্রত্যন্ত এলাকায় এই গ্রাম। মন্দিরে পৌঁছতে, রেলপথ ব্যবহার করাই সঙ্গত। এই গ্রাম থেকে, দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে হাওড়া-খড়্গপুর রুটের হাউর স্টেশন ৬ কিমি, কিংবা ক্ষীরাই স্টেশন ৩ কিমি দূরত্বে অবস্থিত। হাউর থেকে টোটো পাওয়া যাবে।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

10 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৩ চিন্ময় দাশ সীতারাম মন্দির, শ্রীধরপুর (দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)রূপনারায়ণ, শিলাবতী আর কংসাবতী—মুখ্য তিনটি…

12 months ago