নরেশ জানাঃ ২০১৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। দিনটা মনে আছে ৬৮ বছরের বৃদ্ধা অনুরাধা রায়ের। ছেলের সঙ্গে এসেছিলেন কাঁসাই নদীর ঘাটে। খরিদা বাঙালি পাড়ার অনুরাধা রায় ছেলে অনুপম সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন কাঁসাই নদীর দক্ষিণ পাড়ে সেচ দপ্তরের ছোট বাংলোটা ছাড়িয়ে আ্যনিকেট লাগোয়া প্রথম ঘাটে। মোহনপুর থেকে যে রাস্তাটি কাঁসাইয়ের ডানদিক বারবর রূপনারায়নপুরের রানিগঞ্জ-বালেশ্বর ৬০নম্বর সড়কের মুখে গিয়ে পড়েছে, সেই রাস্তার বাঁদিকে এই ঘাট। ২০১৯ সাল অবধি টানা ৪৬ বছর ওই ঘাটে তর্পন করে গেছেন তিনি। প্রথমে স্বামীর সঙ্গে আসতেন, এখন ছেলের সাথে। না, ঝড় জল বৃষ্টি কোনও কিছুতেই বাধা পড়েনি সেই তর্পনে। নদী সরে যেতে দেখেছেন, নদীর মাঝখানে ওই বিশালাকার চরের জন্ম দেখেছেন আর দেখেছেন প্রকাণ্ড বড় বট গাছটিকে ঝুরি নামিয়ে নামিয়ে তরুণ থেকে বৃদ্ধ হতে। ছেলের তর্পন শেষ হলে সেই বটগাছটার গুঁড়ির কাছে তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, ” বিয়ের দ্বিতীয় বছর থেকে স্বামীর সঙ্গে প্রথম তর্পনে আসা। আমার তখন ২০বছর বয়স, স্বামী তর্পন করতেন। আমি এটা ওটা বাড়িয়ে দিতাম আর শুকনো কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম তর্পন শেষে উনি পরবেন বলে। এখন যেমন ছেলের জন্য থাকি। ২০১৯ সালের ওই দিনটি পড়েছিল বাংলার ১০ই আশ্বিন। ঠিক ৬ মাস পরেই শুরু হল লকডাউন। ২০২০ সালের মার্চ মাসে আমি নিজেই করোনা আক্রান্ত হলাম। আমি ভাবতেই পারিনি ফের আজকের এই দিনটা দেখতে পাব। করোনায় কত পরিচিত মানুষকে চলে যেতে দেখলাম! কিন্তু কী আশ্চর্য আমি বেঁচে রয়েছি! হয়ত বেঁচে রয়েছি আজকের এই দিনটি দেখব বলেই।”
শুধু অনুরাধা বা অনুপম নয় কিংবা আ্যনিকেট লাগোয়া এই ঘাট নয়, রবিবার ভোর থেকে কাঁসাইয়ের এপাড়ে যেমন ভিড় উপচে পড়েছে লছমাপুর, কৃষ্ণনগর, জিনশহর, আ্যনিকেট, বড়কোলা থেকে লিলুয়াকোলায় ঠিক ওপারে ভিড় থইথই মেদিনীপুর লাগোয়া ঘাটগুলিতেও। সেই ভিড় ঠেলে জল ছুঁতে হুড়োহুড়ি মহাতাবনগর, হরিশপুর, পাথরা, গান্ধী ঘাট, পালবাড়ি, আমতলা, গোপের গড়ান থেকে কঙ্কাবতী। কোথাও যেন ঠাঁই নেই! ওপাশে যদি ভিড় ছাড়িয়ে যায় খালশিউলি, আমদই তে এপাশে তখন টেক্কা দেয় নেপুরা, চাঁইপুর, মনিদহ। সবারই একই কথা পিতৃপুরুষ জল পাননি দু’বছর, কাঁসাইয়ের জল! কিন্তু কাঁসাই কেন? পুকুরের জল, কুয়োর জলে কী তর্পন হয়না?
গান্ধী ঘাটে দাঁড়িয়ে মেদিনীপুর শহরের বাড় মানিকপুরের নিবারণ ভট্টাচার্য বলেন, “না হয়না। নদী হল বহতা, নদী হল জীবনের প্রতীক। যে জল বহমান নয়, সেই বদ্ধ জলে উর্দ্ধলোক কে উৎসর্গ করা যায়না। তাঁরা তা গ্রহণ করেন না।” খড়গপুরের বড়কলা গ্রামের অর্নব পাল বলেন, ” আসলে পিতৃপুরুষ পবিত্র জল আহ্বান করেন, বহতা নদীই সেই পবিত্রতার আধার। নদী মাত্রই গুর্খা আর আমাদের গঙ্গা হল কাঁসাই, কংসাবতী। বেলা বাড়ে ভিড় হালকা হতে থাকে, ভিড় ঘরে ফেরা শুরু করে। কাতারে কাতারে লোক! চোখে মুখে সে এক অসীম প্রশান্তি। সে প্রশান্তি শুধুই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পনের সার্থকতা নয়। সে প্রশান্তি আরও গভীরে, সে প্রশান্তি করোনা কে হারিয়ে জিতে আসার আর মানুষের ভিড়ে মানুষের মিশে যাওয়ার।
আমাদের কাজ শেষ। ছবি তোলা, কথা বলা, সাক্ষাৎকার সব শেষ। আমরা ফিরে যাচ্ছি। দেরিতে আসা যজমানকে যাজন করাচ্ছেন ভট্টাচার্য মশাই! তাঁর অর্ধ নিমিলিত চোখ! উদাত্ত কন্ঠে তিনি আওড়াচ্ছেন, ‘আব্রহ্মস্তম্ভপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু। তৃপ্যন্তু সর্বমানবা।’ “এই ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছু আমার এই নিবেদিত জলে তৃপ্ত হোক। তৃপ্ত হোক কাছে দূরে যে যেখানে আছ। যাঁদের চিনি অথবা চিনিনা তৃপ্ত হোক, ছেড়ে যাওয়া অথবা কাছে থাকা সব্বাই তৃপ্ত হোক। ব্রহ্ম থেকে তৃণ, প্রানীজগত থেকে জীবজগত তৃপ্ত হোক। সব মানুষ, সমস্ত মানুষ তৃপ্ত হোক।” তৃপ্তি ঝরে পড়ে কাঁসাইয়ের দুই পাড়ে, পড়তেই থাকে।