নিজস্ব সংবাদদাতা: অনেক খারাপ লাগা খবরের মাঝে একটা ভালো খবর। ব্যস্ততম দুনিয়ায় যখন কেউ কারো খোঁজ নেওয়ার সময় পায়না কিংবা প্রকাশ্য রাস্তায় অপরাধ হতে দেখেও রুখে দাঁড়ানো দুরের কথা, ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেনা তখন এমন এক যুবকের কথা যে কিনা রাতের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথ ছেড়ে অন্য পথে দৌড়ায় ছিনতাইবাজদের তাড়া করে এবং প্রায় ৩ কিলোমিটার তাড়া করে ধরেও ফেলে এক ছিনতাইবাজকে! হ্যাঁ, এমনই এক ঘটনায় রাতারাতি নায়ক হয়ে গেলেন খড়গপুরের যুবক স্যামুয়েল। খড়গপুরবাসী ছাড়াও কুড়িয়ে নিলেন পুলিশের প্রশংসা।
ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার, মকর সংক্রান্তির রাতে। রাত তখন পৌনে ১০টা। আর ১৫ মিনিটের মধ্যেই করোনা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যাবে শহরে তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিল স্যামুয়েল। স্যামুয়েল ছোটখাটো ব্যবসা করে। নিজে কেক বানায়। অনলাইনে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে কেক সরবরাহ করে। স্যামুয়েল গোলবাজার ওভারব্রিজ পেরিয়ে ঝাপেটাপুরের বাড়ি ফিরছিল।

তখন সে দেখতে পায় ওভারব্রিজের ওপর একজন জোম্যাটো বয় চিৎকার করছে ছিনতাইবাজরা তার মোবাইল নিয়ে গেল বলে। সবাই যখন ওই জোম্যাটো বয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেও পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন স্যামুয়েল ওই জোম্যাটো বয়ের কাছে বিষয়টি জানতে চায়। জোম্যাটো বয় স্যামুয়েলকে জানায় একটি স্কুটিতে থাকা ৩ ছিনতাইবাজ তার মোবাইল নিয়ে গোলবাজারের দিকে পালাচ্ছে।
স্যামুয়েল জানায়, ‘আমি যখন ব্রীজের ওপর উঠছিলাম তখন একটা স্কুটিতে ৩জনকে যেতে দেখেছিলাম। অস্বাভাবিক লেগেছিল ওদের চলে যাওয়া। খুবই জোরে স্কুটি ছোটাচ্ছিল ওরা, প্রায় ৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। ওই জোম্যাটো বয়ের কাছ থেকে সব কিছু শুনে আমার মনে হয়ে একটু আগে আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ওই স্কুটির ছেলেরাই ছিনতাইবাজ। সাথে সাথে বাইক ঘুরিয়ে তাড়া করি ওদের। গোলবাজারের ভেতর দিয়ে রামমন্দিরকে পাশ কাটিয়ে ওরা ছুটছিল। পেছনে পেছনে আমি। একটু পরে ওরা বুঝতে পারে আমি ওদের তাড়া করছি। ওরা স্কুটির গতি বাড়িয়ে দেয়। ওদের চেজ করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারি প্রায় ৯০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা স্কুটির গতি ওদের।’
স্যামুয়েল বলেন, ‘আমি ওদের চিৎকার করে বলেছিলাম জোম্যাটো বয়ের ছিনতাই করা মোবাইলটা ফেলে দিতে। তাহলে আমি আর তাড়া করবনা। কিন্তু ওরা মোবাইল ফেলেনি। আমিও জেদ ধরে ছিলাম জোম্যাটো বয়ের মোবাইল ফেরৎ আনবই। কারন আমিও একজন ছোট ব্যবসায়ী। জোম্যাটো বয়ের কষ্টটা আমাকেও কাঁদাচ্ছিল। মোবাইল ছাড়া আমাদের ব্যবসা চলেনা। আরেকটা নতুন মোবাইল কেনার ক্ষমতা সবার থাকেনা। ছিনতাইবাজের দল তখন গীতাঞ্জলি কমিউনিটি হলের পেছন দিক দিয়ে বড়বাত্তির রাস্তা ধরে খরিদা লেবেল ক্রসিংয়ের দিকে। লেবেলক্রসিং পেরিয়ে মালঞ্চ রোডে উঠে পড়েছিল ওরা কিন্তু একটা ছোট ভীড় ছিল আর একটা লোক সাইকেল চালিয়ে আসছিল। ছিনতাইবাজের দলটি ওই সাইকেলকে ধাক্কা মেরে পড়ে যায়। দুই ছিনতাইবাজ পালিয়ে যায়। স্কুটি সহ একজন ধরা পড়ে যায়।’
স্যামুয়েলের আওয়াজ শুনে স্থানীয় মানুষজন ধরে ফেলে এক ছিনতাইবাজকে। কয়েকজন চড় থাপ্পড় মারে কিন্তু স্যামুয়েল তাঁদের বলে মারধর না করে পুলিশে খবর দিতে। খবর পেয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ছুটে আসেন খরিদা পুলিশ ফাঁড়ির আধিকারিক ও কর্মীরা। তারা জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে ওই ছিনতাইবাজ ও স্কুটি নিয়ে যান ফাঁড়িতে। যাওয়ার আগে সাবাসি জানিয়ে যান স্যামুয়েলকে। বলেন, স্যামুয়েলরাই খড়গপুরের আসল হিরো। পুলিশ জানতে পেরেছে ধৃত ছিনতাইবাজের নাম বি. অখিল। বাড়ি নিমপুরার ম্যাক্স গ্রাউন্ডের কাছে। অখিলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি ২জনের নাম পরিচয় জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। খোঁজ করা হচ্ছে অখিলের নামে আগে কোনও অপরাধের অভিযোগ রয়েছে কী না।
জোম্যাটো বয়েরও খোঁজ করছে পুলিশ। স্যামুয়েল যখন ফের গোলবাজারের ব্রিজের ওপর ফিরে যান তখন অবশ্য জোম্যাটো বয় সেখানে ছিলনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে হয়ত। পুলিশ জানতে পেরেছে ওই জোম্যাটো বয়ের নাম রূপম। তার মোবাইলটা অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি। সেটা নিয়ে পালিয়েছে ওই দুই ছিনতাইবাজ। পুলিশ সেটা উদ্ধারের চেষ্টা করছে। কী বন্ধুরা স্যামুয়েলের জন্য গর্ব হচ্ছেনা? এ শহর শুধুই চুরি কিংবা ছিনতাইয়ের গল্প শোনায়না, স্যামুয়েলেরও গল্প বলে।