শশাঙ্ক প্রধান: কেউ ২০ বছর আবার কেউ ২৫বছর ধরে রাখি বানান। আরও পরে বিয়ে হয়ে এসেছেন এমন কেউ কেউ ১০ বছর থেকে ১৫বছর। রাখির সময় রাখি, পুজোর সময় মালা, অন্য সময় আরও অন্য কিছু। তবে রাখিই যেহেতু সবচেয়ে বেশি বানানো হয় তাই এলাকার নামই হয়ে গেছে রাখি পাড়া। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানার দেভোগ গ্রাম পঞ্চায়েতের কুচইপুর গ্রামের রাখি পাড়ায় আগামী কালও উঠবে রাখি পূর্ণিমার চাঁদ কিন্তু সে চাঁদ যেন নিষ্প্রভ, আলোহীন চাঁদ। সে চাঁদের বাঁধ ভেঙে হাসির বদলে যেন কান্না। সে চাঁদ এখন আর খুশি আনেনা রাখি পাড়ার ৩০/৩৫টি পরিবারে। করোনা এসে কেড়ে নিয়ে গেছে সব হাসি। মাস গেলে যে মহিলাদের হাতে পাঁচ ছ’হাজার টাকা আসত এখন সেখানে হাজার টাকাও আসেনা।
রাখি পাড়ায় রাখি বানানোর সরঞ্জাম পৌঁছে দিত মহাজন। বাড়িতে বাড়িতে মহিলারা সেই রাখি বানিয়ে ফেরৎ দিত মহাজনকে। দিনে কেউ দেড়শ, কেউ দু’শ, তিনশ অবধি যায় করতেন। যার যেমন হাত তৈরি হত তাঁর তেমন আয়। এই আয় দিয়েই ছেলে মেয়েদের বই খাতা পেন পেন্সিল, পুজোর সময় নতুন জামা, শীতের সময় গরম পোশাক কিনে দিতেন মেয়েরাই। এছাড়াও অসুখ বিসুখ থেকে সংসারের পাঁচ মেশালি কাজে টুকিটাকি সুরাহা হত। কিন্তু করোনা কেড়ে নিয়েছে সব। গত বছর একেবারেই রাখি তৈরি করায়নি মহাজন আর এবছর যা সরঞ্জাম দিয়ে গেছে তাতে দিনে ৫০টাকার কাজ হলে হয়, তাও সবার জন্য নয়। সবংয়ের এই রাখি পাড়ার রাখিই মহাজনের হাত ধরে কলকাতার বড়বাজার হয়ে পাড়ি জমাত দিল্লি মুম্বাই রাজস্থানে কিন্তু এখন তা সবংয়ের তেমাথানি বাজারের মোড় পের হয়না।
রাখি পাড়ার ৬৩ বছর বয়সী হাসি গাঁতাইত বলেন দিনভর ৭০০-১০০০ রাখি বানিয়ে হাতে আসত ১৫০ থেকে ২০০ টাকা উপার্জন হত। বাংলায় যেমন শুধু রাখির সময় রাখি অনেক প্রদেশে তার বাইরেও সারা বছর রাখির চল আছে। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে, বিয়ে বাড়িতে, সাজসজ্জায় রাখির চল রয়েছে ফলে সারা বছর রাখির একটা বাজার রয়েছে। পাশাপাশি ইমিটেশনের মালা ইত্যাদি মিলিয়ে এই বয়সেও নিজের খরচ চালিয়ে যেতাম। কারও কাছে হাত পাততে তো হতই না বরং সংসারে কিছুটা সুরাহা হত। এখন সব শেষ। রাখি পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে মনটা হুহু করে ওঠে। তিনি আরও বলেন সরকারের থেকে কোন সুযোগ সুবিধা আমরা পাইনি,বয়স ৬০ পেরিয়ে গেলেও বার্ধক্য ভাতা সেটাও নেই কপালে, কতবার এই বয়সে পঞ্চায়েতের কাছে গিয়েছি তার কোন ঠিক নেই।
রাখি পাড়ার আরেক গৃহবধূ অনিতা গাঁতাইত জানান, ‘৫ জনের সংসার আমাদের। স্বামীকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে হত। লকডাউনে ফিরে এসেছেন। ধার দেনা করে একটা টোটো কিনেছেন। লোকাল এলাকায় কী উপার্জন হয় তা’দিয়ে? ভরসা ছিল অন্ততঃ রাখি বানিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারব। ছেলে মেয়ে গুলোকে খুব বেশি না হলেও অল্প স্বল্প কিছু দিতে পারব কিন্তু কিছুই হয়না। টোটো কেনার ধার শোধ করতেই সব চলে যায়। রাখির বাজার প্রায় বন্ধের দিকে,খাবো কি আমরা? তবুও যতটুকু পারি এই রাখি বানাই। কোথায় দুয়ারে সরকার? আমাদের দুয়ারে শুধু অভাব এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বাচ্চাদের দিকে তাকানো যায়না।
২০১৫ সালে রাখি পাড়ায় গৃহবধূ হয়ে আসার পর থেকে রাখি বানান মৌমিতা গাঁতাইত। তাঁরও অবস্থা সেই একই। এখন রাখি বানাতে হয় বানান পাশাপাশি হাঁস মুরগি চাষের কথাও ভাবছেন। মৌমিতা বলেন, ‘একজনের আয়ে সংসার চলেনা। ঘরের মানুষটার পাশে দাঁড়াতে হয় কিন্তু কী করব বলুনতো? রাখি বানিয়ে আর আয় হয়না তেমন। সরকারের কোনও সুযোগ সুবিধা পাইনি। দুয়ারে সরকারে গেছিলাম। বলেছে সময় আসলে সব পাবেন। এখন সেই সময়ের অপেক্ষায় বসে আছি।’ যে রাখি পাড়া একসময় রাখির সময় গমগম করত এখন সেখানে শশ্মানের নিস্তব্ধতা।