নিজস্ব সংবাদদাতা: দেশে না থাকলেই বোঝা যায় দেশের মাটির মূল্য যেমনটা মা না থাকলে বোঝা যায় মায়ের মর্ম। কবি লিখেছিলেন, ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা! বিমানের ল্যাডার বেয়ে কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার চোখ দিয়ে অবিরল গড়িয়ে পড়ছিল জলের ধারা। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ টা ৪০ মিনিট! ইউক্রেন সীমান্ত থেকে হাঙ্গেরি থেকে দিল্লি হয়ে বিমান বন্দরে পা রাখলেন অনন্যা। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইউক্রেনে আটকে পড়া পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রথম পড়ুয়া। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে তখন অনন্যা দেখে হাত নাড়ছেন দাঁতন কন্যার বাবা মা, মাসি মেসো। কিন্তু অনন্যা সে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছিলনা। ইউক্রেনের সেন্ট্রাল কিয়েভ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অনন্যা তখন কাঁদছেন, দেশের মাটি ছুঁতে পারার আনন্দের কান্না।
দাঁতন গড়হরিপুর থেকেই একটি গাড়ি ভাড়া করে বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলেন অনন্যার বাবা অশোক কুমার পাইক, মা অপর্ণা সিকদার পাইক, মাসি, মেসো। কলকাতা থেকে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে রাত আটটা পেরিয়ে গেল! গড়হরিপুরের বাড়িতে পৌঁছালেন রাত ১২টা নাগাদ। অত রাতেও ঘুমোননি পড়শিরাও। গ্রামের মেয়ে মৃত্যুভূমি থেকে ঘরে ফিরছে বলে কথা। মেয়ে ফিরছে শুনে সকাল থেকেই খুশিতে ভরে উঠেছিল গড়হরিপুর। রাতে গুটি গুটি পায়ে তাঁরাই হাজির হলেন পাইক পরিবারের ঘরটিতে। সব্বাইকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি অনন্যা। আরও একবার তাঁর চোখে জল চলে এল। শুক্রবার রাত ৯টা নাগাদ ‘KGP বাংলা’ যোগাযোগ করল অনন্যার সঙ্গে, তাঁর বাবার ফোন মারফৎ। অনন্যাদের গাড়িটি তখন কোনা এক্সপ্রেস ছাড়িয়ে হাওড়া মুম্বাই জাতীয় সড়কে পড়েছে। জানালেন, কিভাবে রাজধানী কিভ থেকে পৌঁছালেন হাঙ্গেরির সীমান্তে।
বললেন, ‘ যুদ্ধের চতুর্থ দিনের মাথায় আমরা ক’জন মিলে ঠিক করলাম, আর এই মৃত্যু উপত্যকায় নয়, যেমন করেই হোক ছাড়তে হবে কীভ। গনপরিবহনের কার্যত কোনও ব্যবস্থাই নেই কীভ কিংবা তার আশেপাশে। ১২/১৪ মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করলে ভাড়া চায় দু’ হাজার ডলার। অত টাকা কোথায় পাবো? শেষমেশ ২৮ মার্চ আমরা ৬ জন ভারতীয় বেরিয়ে পড়লাম হাঙ্গেরির উদ্দেশ্যে, রাস্তায় গাড়ি নেই, কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ট্রেন ধরলাম। ট্রেনে, বাসে, হেঁটে প্রায় ২২ ঘণ্টার চেষ্টায় হাঙ্গেরি পৌঁছালাম। সে এক ভয়ংকর যাত্রা। সঙ্গে না আছে জল, না খাবার। শুনশান তুষার মোড়া রাস্তায় কেউ নেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মনে একটাই আকাঙ্খা, একটাই জেদ, যেভাবেই হোক পৌঁছাতেই হবে। অবশেষে হাঙ্গেরি সীমান্ত, চেকিং পয়েন্ট। ঠান্ডায় যেন মমি হয়ে যাচ্ছিল শরীর। তারই মধ্যে ওই রাতটা রাস্তায় শুয়েই কাটানো। ২ তারিখ হাঙ্গেরির আকাশ ছুঁল বিমান, ৩ তারিখ দিল্লি। আমার দেশ। একটা রাত দিল্লিতে কাটিয়ে অবশেষে কলকাতা, মনে হল জীবন ফিরে পেলাম।”
রুশ আক্রমনের সময় গুলি উল্লেখ করে অনন্যা বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ২৮ তারিখ হাঙ্গেরি সীমান্তে পৌঁছানো অবধি পায়ে পায়ে যেন মৃত্যু তাড়া করে বেরিয়েছে আমাদের। ওই কটা দিন কীভাবে কাটিয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। যখন কীভের দখল নিচ্ছে রুশ সেনা, তখন হস্টেলের বাঙ্কারে তিনশো জন ছাত্রছাত্রী কোনও রকমে মাথা গুঁজে থেকেছি। বোমার শব্দে বুক কেঁপে যাচ্ছে। খাবার নেই, জল নেই। মনে হচ্ছিল, এই শেষ বারের মত পৃথিবী দেখা! মা বাবা মেদিনীপুর বেলদা দাঁতন আর কোনও দিন দেখা হবেনা। কলকাতার মাটি ছোঁবার পর তাই চোখে জল চলে এল। মনে পড়ে গেল কবিগুরুর সেই কবিতা, ও আমার দেশের মাটি।
ইউক্রেনের মাটি থেকে অনন্যাই প্রথম পশ্চিম মেদিনীপুরের পড়ুয়া যিনি দেশে ফিরলেন । এখনও ফিরতে পারেননি বেলদার অনিন্দিতা, সবংয়ের সুশোভন, চন্দ্রকোনার ইয়াসিনরা। একরাশ উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ দিয়ে দিন কাটছে পরিবারগুলির। সরকারের কাছে সবার জন্য সমবেত প্রার্থনায় অনন্যাও। বলেছেন, সবাই দ্রুত ফিরে আসুন, ভালভাবে ফিরে আসুন এই কামনা করছি। ওই বধ্যভূমিতে থাকা প্রতিটি মিনিটই মৃত্যুর আতঙ্কতে ভরা। সেই আতঙ্ক থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হয় তত মঙ্গল।