নিত্য গুপ্ত: সেই ছবিটা আজও ভারতবাসীর বুকে বেঁচে আছে। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল ক্যাম্পাস থেকে চার সতীর্থর সঙ্গে বেরিয়ে আসছেন রোহিত। এক হাতে একটা মোটা পিচবোর্ডের কার্টুন, বিছানাপত্র। ওভাবেই থাকতে হত রোহিতদের। কারন খাট পালঙ্কের বরাদ্দ ছিলনা। রোহিতের অন্য হাতে সযত্নে ধরে রাখা বাবা সাহেবের ছবি। বাবা সাহেব আম্বেদকর, স্বাধীন ভারতের দলিত আর ছোটজাত, হরিজনদের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।
২৬বছরের পিএইচডির ছাত্রকে কোনও কারন ছাড়াই বহিস্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। না, কারন ছিল। রোহিতের পদবী ভেমুলা, রোহিত দলিত ছিলেন। তার আগের দিন গুলো আরও সাংঘাতিক। রোহিতের জনপ্রিয়তা মানতে পারছেনা আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি। আম্বেদকর স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা নিয়ে রোহিত কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাস।

পরের ছ’মাস দীর্ঘ লড়াই রোহিতের। দীর্ঘ ছমাস বিনা তদন্ত ছাড়াই সাসপেন্ড, হস্টেল থেকে বহিষ্কৃত, স্কলারশিপ বন্ধ। কিন্তু কোনও জবাব নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষর। ডিসেম্বরের শেষে
রোহিত শুরু করলেন অনশন। ১২ দিন অনশনের পরও কর্তৃপক্ষের দেখা মেলেনি। তারপর ভারতের জাতপাতের রাজনীতির ইতিহাসে কালো দিন, ২০১৫ সালের ১৭ই জানুয়ারি। রোহিতের আত্মহত্যা। যদিও রোহিতের পরিবারের দাবি খুন করা হয়েছে তাঁকে। হত্যা যদি সরাসরি নাও হয়, প্ররোচনা আর গাফিলতি ছিল দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের।এই অভিযোগেই উত্তাল হয়ে ওঠে প্রথমে হায়দরাবাদ, পরে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, সবশেষে সংসদ।
সংসদ যখন তোলপাড়,তখন আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী,সুষমা স্বরাজ ঘোষণা করেছিলেন, তদন্ত হবে।কিন্তু সে তদন্ত রোহিতের মৃত্যু নিয়ে নয়। তার জাতের শংসাপত্র নিয়ে। আদৌ কি দলিত ছিলেন রোহিত ভেমুলা? সরকার তখন দলিত হত্যার চিহ্ন হাত থেকে মুছে ফেলতে উদ্যত।
সরকার প্রচুর চেষ্টা করেছে রোহিতকে নিজেদের মানে বর্ণবাদীর জাতে তোলার, সে যে দলিত নয় তা প্রমাণ করার। সরকার যতনা চেষ্টা করেছে তারও চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে বিজেপি, আরএসএস, বজরংদল ইত্যাদি ইত্যাদি আর নাগপুরের হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি কিন্তু শেষ অবধি সে তদন্তও অবশ্য সরকারের বিরুদ্ধেই গেছে। দেশজোড়া প্রতিবাদ,তোলপাড়ের পর সে তদন্ত শেষ হয়েছে। সরকার-ই জানিয়েছে নিশ্চিতভাবে দলিত ছিলেন রোহিত। দলিত নিপীড়নে অভিযুক্ত দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর অভিযোগ থেকে মুক্তি মেলেনি। তবে তাদের একবারের জন্যও প্রশ্ন করে বিব্রত করেনি, পুলিশ-প্রশাসন। দেশ আগের মতই চলছে। মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোর দায়ে,দলিতদের রাস্তায় ফেলে পেটানো চলছে। কেবল একটা কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। দলিতদের অসম্মান,মৃত্যু, সর্বোপরি দলিতদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে ভয় পায় এই ব্যবস্থা। তাই আজও দলিত রোহিতের মৃত্যু কিভাবে জানা গেল না। অথচ, তাঁকে অ-দলিত প্রমাণ করতে ছমাস ধরে চেষ্টা চলল। যেন অ-দলিত হলেই হত্যা কলঙ্কের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায় এই বর্ণবাদ, মনুবাদ আর আর.এস.এসের দল। আজ রোহিত ভেমুলা সশরীরে থাকলে ৩২ বছর বয়সী হতেন, কিন্তু কী আশ্চর্য! ছাব্বিশের তারুণ্য নিয়েই আজও বেঁচে আছেন রোহিত। তাঁর সেই বাঁধন ভাঙার গান গাইছেন হায়দ্রাবাদ, দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতার তারুণ্যের দল।