Wednesday, May 22, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৭১ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল                                                          চিন্ময় দাশ         রাধাকৃষ্ণ মন্দির, ছোট খেলনা                            (পিংলা,পশ্চিম মেদিনীপুর)
ভারি অভিশপ্ত এক মন্দিরের কথকতা আজকের জার্ণালে। মন্দির গড়েও, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি এই মন্দিরে। অনাদরে অবহেলায় জীর্ণ হতে হতে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গিয়েছে সৌধটি।
মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সব আয়োজনও সারা। সেই আবহে কোন দৈব দুর্বিপাকে মন্দিরটি অপবিত্র হয়ে গেল। শাস্ত্রীয় বিধানে, সেই কলুষিত সৌধে দেবতার বিগ্রহের অধিষ্ঠান করা যায়নি। মেদিনীপুর জেলায় এরকম আরও ৩টি অভিশপ্ত মন্দির আমরা সমীক্ষা করেছি। ১. ময়না থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের জমিদার ঘোড়ই বংশের নব-রত্ন বিষ্ণু মন্দির। ২. মেদিনীপুর কোতওয়ালি থানার পাথরা গ্রামে জমিদার মজুমদার বংশের নব-রত্ন নবগ্রহ মন্দির। ৩. তমলুক শহরের অদূরে, বঁহিচবেড়িয়া গ্রামে তমলুকের জমিদার রায় বংশের নব-রত্ন ও পঞ্চ-রত্ন দুটি কৃষ্ণমন্দির।
শকুনি বসে গিয়েছিল কোনও মন্দিরের মাথায়। কোথাও মন্দিরের মাথায় বজ্রপাত হয়েছিল।
পিংলা থানার এই মন্দির কোন রাজা বা জমিদারের হাতে গড়া নয়। একটু অর্থসম্পন্ন এক বৈষ্ণব বংশের হাতে গড়ে উঠেছিল মন্দিরটি। সেসময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল স্রোতে মেদিনীপুর জেলা প্লাবিত। চৈতন্যদেবের বিধান—আচণ্ডাল ব্রাহ্মণ সকলেরই আছে দেবসেবার অধিকার।
ছোট খেলনা গ্রামের দাস পদবীর একটি বৈষ্ণব পরিবার দেবসেবার জন্য একটি মন্দির গড়েছিল। মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য, যাগযজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ। সেই শুভ কাজের প্রাক্কালেই শকুন বসে পড়েছিল মন্দিরের মাথায়।
এ ভারি অশুভ ইঙ্গিত। ব্রাহ্মন্য বিধানে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি মন্দিরে। অগত্যা দাসবংশের বসতবাড়িতে রেখেই সেবাপূজা করা হত রাধাকৃষ্ণের।
দাস বংশের শেষ পুরুষ ছিলেন যাদবরাম দাস। তাঁর পত্নী কিরণবালা দেবী। পরিতাপের কথা, এই ধর্মপ্রাণ দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁদের প্রয়াণে, দাসবংশটিই অব্লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে, শেষ বয়সে পৌঁছে, বিগ্রহ দুটির সুব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা।
সেসময় গ্রামেরই ঘোড়ই পদবীর একটি পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে, ‘দাস’ পদবী গ্রহণ করেছিল। সেই ধার্মিক পরিবারটির হাতে বিগ্রহ দুটি তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন যাদবরাম। কয়েক পুরুষ ধরে সেখানেই পূজিত হচ্ছেন দুই দেবদেবী। কোন দিনই মন্দিরে অধিষ্ঠানের সুযোগ হয়ে ওঠেনি বিগ্রহ দুটির।
বর্তমানে অতি জীর্ণ সেই মন্দিরের যতটুকু অংশ এখন টিকে আছে, তাকে মন্দিরের কঙ্কাল ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সেই কঙ্কালকে আবার ঢেকে রেখেছে বড় বড় গাছপালা, ঝোপঝাড়, আর সবুজ শ্যাওলার পুরু আস্তরণ।
পূর্ববর্তী পুরা গবেষকগণের কেউই আসেননি এই মদিরে। তাঁদের বিবরণে এই মন্দিরের কোন উল্লেখই পাওয়া যায় না। এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে কাঠামোর যতটুকু অবয়ব টিকে আছে সেটি দেখে, আর, সেবাইত, পুরোহিত এবং গ্রামের প্রবীনদের সাথে আলাপচারিতে থেকে অনুধাবন করে।
রাধাকৃষ্ণের এই মন্দিরটি ইটের তৈরি আর দক্ষিণমুখী। বর্গাকার আর পঞ্চ-রত্ন রীতির। সামনে খিলানের তিনটি দ্বারপথ যুক্ত অলিন্দ। তার সিলিং হয়েছিল দুটি অর্ধ-খিলানের সাহায্যে। মন্দিরের থামগুলি রচিত হয়েছিল অত্যন্ত বিরল চুমকি-রীতিতে। গর্ভগৃহে সিলিং হয়েছিল, দুটি বড় খিলানের উপর, গম্বুজ রচনা করে।
উপরে পাঁচটি রত্নেই কলিঙ্গধারায় রথ বিভাজন এবং পীঢ়-ভাগ করা হয়েছিল। কিন্তু রত্নগুলির পাঁচটি শীর্ষকই অবলুপ্ত। সেগুলির গড়ন দেখা যায় না।
মন্দিরে অলঙ্করণ করা হয়েছিল টেরাকোটা আর পঙ্খের মাধ্যমে। যদিও প্রায় সবই তার বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। খুঁজেপেতে সামান্য দুটি একটি নমুনাই কেবল দেখা যায় এখন।
তা থেকে অনুমান করা যায়—১. টেরাকোটার ফলক ছিল সামনের দেওয়ালে। ২. ৩টি খিলানের মাথায় তিনটি বড় প্রস্থে। ৩. কার্ণিশের নীচ বরাবর সমান্তরাল একটি বা দুটি সারিতে। ৪. মন্দিরের অভ্যন্তর অংশে গর্ভগৃহের দেওয়ালে। ৫. মন্দিরের মাথায় রত্নগুলির রাহাপাগ অংশের উপরেও।
তবে, এ সবের মধ্যে, বর্তমানে কেবল গর্ভগৃহের দেওয়ালে কয়েকটি শতদল পদ্ম এবং কেন্দ্রীয় রত্নের রাহা অংশে একটি মিথুন-মূর্তিই কেবলকোন রকমে টিকে আছে। এগুলি টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কাজ। অপরদিকে, পঙ্খের কাজের কিছু নমুনা আছে গর্ভগৃহের প্রবেশপথের মাথার উপর।
অন্য কোন নমুনা আজ আর দেখা যায় না। সকলই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে, মন্দিরটি মসৃণ পঙ্খের প্রলেপে মোড়া ছিল, এটি এখনও দেখা ও বোঝা যায়।
বর্তমানে এই সৌধটির যা অবস্থা, সংস্কার কিংবা সংরক্ষণের কোনও সুযোগ নাই আর। একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-সম্পদ অনাদরে অবহেলায় সকলের চোখের সামনে তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে গেল—এই হা-হুতাশ আর বুক ভরা বেদনাই সঙ্গী হয়ে থাকল আমাদের!
সম্পূর্ণ বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়ার আগে, আমরা কেবল এই অভিশপ্ত মন্দিরের ইতিহাসটুকু লিখে রাখলাম এখানে।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী রঘুনাথ (মন্টু) অধিকারী—ছোট খেলনা।
সমীক্ষা সহযোগীঃ শ্রী প্রদীপ কুমার রাউত—মধ্যবাড়, থানা—পিংলা।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর-ময়না রাস্তায় মালিগ্রাম কিংবা ছোট খেলনা বাসস্টপ। সেখান থেকে কিমি দুয়েক দূরে মন্দিরটি অবস্থিত। তমলুক থেকে বলাইপণ্ডা হয়ে বালিচক মুখী রাস্তাতেই ঐ দুটি স্টপেজ।

- Advertisement -
Latest news
Related news