নিজস্ব সংবাদদাতা: খবরের ৯০% জুড়ে তাঁদেরই খবর! দুয়ারে সরকার থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডার, সমস্ত সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে তৃনমুল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার। কিন্তু তারপরেও সংবাদকর্মীদের ওপর ঝাল মেটানো চাই। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেলদা, দাঁতন, নারায়নগড়, কেশিয়াড়ী, মোহনপুর সরকারের অনুষ্ঠান কিংবা শাসকদলের কর্মসূচি ডাক পড়ে স্থানীয় তরুণ সাংবাদিক সঞ্জয় দাসের। সেই সঞ্জয় দাসকেই বেধড়ক পেটালেন একদল উন্মত্ত তৃনমূল কর্মী সমর্থক।
সঞ্জয়ের অপরাধ, সে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনে একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাওয়া বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে ঘিরে তৃনমূল কর্মীদের বিক্ষোভের ভিডিও করছিলেন। তৃনমূলের এই কর্মসূচি কোনও গোপন কর্মসূচি ছিলনা। তৃনমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অবধি এই কর্মসূচিকে জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ বলে বৈধতা দিয়েছে। সেই বিক্ষোভের ছবি করতে যাওয়াটা কী এমন অপরাধের যে ওই নৃশংস মার খেতে হল তাকে?
সঞ্জয় জানিয়েছে, ‘ঘটনাটি ঘটেছে বিকাল ৪টা নাগাদ। মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষ, তাঁর সংসদীয় এলাকার, দাঁতন বিধানসভার সাহানিয়া এলাকায় বুধবার দুপুরে একটি দলীয় কর্মসূচীতে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি যাচ্ছিলাম সেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য। সাহানিয়া গ্রামে যাওয়ার পথে মনোহরপুর বাজারের কাছে একটি “দুয়ারে সরকার” কর্মসূচির শিবির চলছিল। অভিযোগ, সেই শিবিরে থাকা কিছু তৃনমূল কর্মী ঘোষের গাড়ি আটকায়। তাঁরা দাবি করেন, কেন দিলীপ ঘোষ, সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিকে ‘ যমের দুয়ারে সরকার’ বলে কটাক্ষ করেছেন? তাঁকে সাহানিয়া যেতেই দেওয়া হবেনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই কর্মীরা তারা দিলীপ ঘোষের গাড়ির সামনের অংশে আঘাত করতে থাকে। ঘোষের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা তাঁকে ঐ অবস্থা থেকে বের করে আনে। এই ঘটনার ভিডিও করছিলাম আমি। কেন আমি ভিডিও করছি এই প্রশ্ন তুলে মারধর শুরু হয় আমাকে। আমার কোনও কথাই ওরা শুনতে চায়নি।”
জানা গেছে প্রথমে চার পাঁচজন মিলে কিল চড় ঘুঁষি মারতে থাকে সঞ্জয়কে। সঞ্জয়ের পেটে একটা ঘুঁষি পড়ার পর যখন সে যন্ত্রনায় কুঁকড়ে নিজের পেট ধরে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিলেন তখনই পেছনে থেকে একটা লাথি কষানো হয় তার কোমরে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান সঞ্জয়। এরপরই ওপর থেকে ক্রমাগত লাথি মারা হতে থাকে তাঁকে। একেবারে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সঞ্জয়ের পায়ের আঙুল, হাতের কব্জি ইত্যাদি স্পর্শকাতর জায়গা গুলিতে বারংবার মারা হয়েছে। সঞ্জয় জানিয়েছেন, ‘ততক্ষনে আমার দুটো মোবাইলই কেড়ে নিয়েছিল ওরা। আমি কোনোও রকমে উঠে পালানোর চেষ্টা করি কিন্তু শরীরময় এতটাই ব্যথা হচ্ছিল যে আমি দৌড়াতে পারিনি। উন্মত্ত মানুষগুলো ফের আমাকে ধরে ফেলে। এবার আমাকে বসিয়ে প্রশ্ন করা হয় কেন আমি ছবি তুলেছিলাম, ভিডিও করছিলাম? ওরা আমাকে ফের মারার উদ্যোগ নেয়। বাধ্য হয়ে আমি বলি আমার ভুল হয়েছে। না’হলে ওরা আমাকে হয়ত মেরেই ফেলত।”
ততক্ষণে সাহানিয়া গ্রামের কর্মসূচি বাতিল করে ফিরে গেছেন দিলীপ ঘোষ। তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরাই তাঁকে পরামর্শ দেন ফিরে যাওয়ার জন্য না’হলে আরও বড়সড় ঘটনা ঘটতে পারে। এদিকে সঞ্জয়কে বসিয়ে রাখা হয়। ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান জেলা তৃনমূল সাধারণ সম্পাদক মনিশঙ্কর মিশ্র। তিনিও এসে একই প্রশ্ন তোলেন, কেন ঘটনার ভিডিও করা হচ্ছিল? তাঁর উদ্যোগে অবশ্য ফেরৎ পাওয়া যায় সঞ্জয়ের মোবাইল দুটি যদিও মোবাইল থেকে ডিলিট করা হয় সমস্ত ভিডিও। প্রায় ১ঘন্টা পরে মনোহরপুর থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পান সঞ্জয়। এরপর বেলদা গ্রামীন হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করান তিনি। ঘটনার পর অবশ্য স্থানীয় দাঁতন ব্লক তৃনমূল সভাপতি প্রতুল দাস ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন সঞ্জয়ের কাছে। তৃনমূলের সদ্য মনোনীত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি সুজয় হাজরাও ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সঞ্জয়কে পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সঞ্জয় নিজে অবশ্য এখনও পুলিশের দ্বারস্থ হননি। কারন তাঁর ধারণা যে এলাকায় তাঁকে কাজ করতে হয় সেখানে তৃনমূলের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করলে আরও প্রতিহিংসার মধ্যে পড়তে হবে তাঁকে। সঞ্জয়ের এই উপলব্ধিই যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে বুঝতেই হয় কি দারুন গণতন্ত্র প্রসারিত হয়েছে বাংলায়। একজন সাংবাদিক যেখানে পুলিশে যেতে ভয় পায় সেখানে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? সাংবাদিকরা বন্দুক নয়, কলম কিংবা ক্যামেরা নিয়ে ছোটেন ঘটনাস্থলে আর সেই কারণেই খুব সহজেই টার্গেট বানানো যায় তাঁদের। খুব সহজেই নিজের নিজের এলাকায় ‘তালিবান’ হয়ে ওঠা যায়। সুজয় হাজরা, প্রতুল দাসদের কাছে আবেদন থাকল শুধুমাত্র দুঃখপ্রকাশের আড়ম্বর নয়, দোষি খুঁজে তাদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিন আপনারা। সেটাই হবে প্রকৃত দুঃখপ্রকাশ নচেৎ প্রতিটি দুঃখপ্রকাশের পরই আরও একজন সাংবাদিক টার্গেট হবেন। আর কে বলতে পারে সাংবাদিক পিটিয়ে রেহাই পাওয়া হাত পা গুলো একদিন সাধারন মানুষকে এমনকি দলেরই লোকজনদের পেটানোর জন্য তৈরি হবেনা?
পাশাপাশি একই অনুরোধ থাকল জেলা, মহকুমায় থাকা একাধিক সাংবাদকর্মী সংগঠনের প্রতিও। একটি মহকুমার প্রান্তিক এলাকার ছোট সাংবাদিক বলে বিষয়টিকে না দেখে নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছেন মনে করে বিষয়টিকে দেখা হোক কারন ছোট হাতই একদিন বড় হাতে পরিণত হয়। এটা কোনও ঝোঁকের বশে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়, সঞ্জয়কে পেটানো হয়েছে পরিকল্পনা মাফিক অংক কষেই।