জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ

নন্দেশ্বর শিব মন্দির, মালঞ্চ (খড়গপুর শহর)
উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিকের ঘটনা। খড়গপুরের রাঙা মোরামের ঢিবি বা ‘দমদমা’র উপর বি. এন. আর. (বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে)-এর জংশন স্টেশন গড়ে তুলেছিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী। তখন থেকেই খড়গপুরের শহর হিসাবে গড়ে ওঠার শুরু।
কিন্তু রেল পত্তনেরও দেড়শ বছর আগে, এক জমিদার পরিবার এসেছিলেন এই পাথুরে এলাকায়। নিজের বসতবাড়ির সাথে দুটি দেবালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা—দক্ষিণা কালীর মন্দির এবং আমাদের এই জার্ণালের আলোচ্য নন্দেশ্বর শিব মন্দির।
প্রথমে সংক্ষেপে জমিদার বংশটির পত্তনের কথা বলে নিই। গঙ্গার পশ্চিম তীরে হাওড়া জেলার বালি গ্রামে বাস ছিল দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ একটি ঘোষবংশের। সেই বংশের জনৈক মকরন্দ ঘোষ মেদিনীপুরের খড়গপুর পরগণায় এসে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে একটি জনপদও গড়ে উঠেছিল জমিদারবাড়ীকে কেন্দ্র করে। নিজের বিশাল অট্টালিকার সাথে, যক্ষেশ্বর নামে একটি শিবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঘোষমশাই। তা থেকেই নতুন জনপদটি ‘জকপুর’ গ্রাম হিসাবে পরিচিত হয়েছিল।
পরবর্তীকালে এই জমিদারবংশ ‘রায়’ এবং ‘মহাশয়’ খেতাব পেয়েছিল বাংলার নবাব দরবার থেকে। যাইহোক, এই বংশের এক উত্তরপুরুষ মাধবরাম রায় মহাশয় জকপুর থেকে বর্তমান খড়গপুর সহরের পশ্চিম এলাকা মালঞ্চতে উঠে এসেছিলেন। তাঁর দুই পুত্র—গোবিন্দরাম এবং নন্দরাম। শৈব ও শাক্ত মতে বিশ্বাসী এই দুই সহোদর ভাই দুটি উল্লেখযোগ্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখানে। নন্দেশ্বর শিব মন্দিরটি তার একটি।
১৬৪১ শকাব্দ বা বাংলা ১২২৭ সনে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। একটি প্রতিষ্ঠা-লিপি আছে মন্দিরে। তার বয়ানের একটি অংশ—“শঙ্কর শঙ্করি পদে সদা অভিলাষ। লক্ষ্মী সহ গোবিন্দে রাখহ পুরি আষ।।“ (বানান হুবহু)
এই বয়ানের সূত্রে কেউ বলেন, মন্দিরটি গোবিন্দরাম রায় মহাশয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার, অন্যেরা বলেন, গোবিন্দরাম নন, বরং তাঁর ভাই নন্দরাম, যিনি নিজেও একজন বড় মাপের জমিদার ছিলেন, তিনিই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজের নামের সাথে “ঈশ্বর” শব্দ যোগ করে, দেবতার নামটিও করেছিলেন—নন্দেশ্বর শিব।
গোবিন্দরাম কিংবা নন্দরাম—কে গড়েছিলেন, আমরা এই মতান্তরে না গিয়ে বলি—ইং ১৭১৯-২০ সালে বিখ্যাত রায় মহাশয় বংশের হাতে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
এই বংশের হাতে নির্মিত মালঞ্চের দক্ষিণা কালী মন্দিরটি আট-চালা রীতির। কিন্তু নন্দেশ্বর শিবের এই মন্দিরটি শিখর-দেউল রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছিল।
তিনটি পৃথক সৌধ এই মন্দিরে—সামনে জগমোহন, পিছনে বিমান বা মূল মন্দির। আর, এই দুইয়ের মাঝখানে প্রশস্ত আকারের একটি অন্তরাল। জগমোহন সৌধটি পীঢ়া-দেউল হিসাবে নির্মিত। এর গন্ডী বা মাথার ছাউনি অংশটি ভূমির সমান্তরালে পাঁচটি থাক হিসাবে ভাগ করা। বিমানটি শিখর রীতির।
কলিঙ্গশৈলীর প্রভাবে রথ-বিভাজন করা হয়েছে এই মন্দিরে। জগমোহনে নব-রথ এবং বিমানে সপ্ত-রথ বিন্যাস করা। তিনটি সৌধেই শীর্ষকগুলি ভারি সুদর্শন।
ওডিশী শৈলীর আরও একটি ছাপ দেখা যায় চতুর্দ্বারী জগমোহনে। ভিতরের দ্বারটি অন্তরালের সাথে যুক্ত। বাকি তিন দিকের তিনটি দ্বারপথের উপর তিনটি ‘প্রতিকৃতি-দেউল’ রচিত হয়েছে। সেটির ছাউনি অংশেও পাঁচটি থাকের পীঢ় ভাগ করা।
উঁচু ভিতের উপর ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথরের পশ্চিমমুখী মন্দির। মন্দিরের প্রত্যেকটি দেওয়াল ৫ ফুট চওড়া। দ্বারপথগুলি খিলান-রীতির।
স্বল্প কিছু অলঙ্করন আছে মন্দিরে। জগমোহনের সামনের দেওয়ালে কয়েকটি দেব-দেবীর মূর্তি আছে। বিমান সৌধের উপরের গণ্ডী অংশে আছে ব্যাদিত-বদন সিংহ মূর্তি। কয়েকটি মিথুন-মূর্তিও রচিত হয়েছে বিমানের বাঢ় অংশে।
নন্দেশ্বর মন্দিরের দক্ষিণ দিকে শিবলিঙ্গ সহ গম্ভীরাটি সারা বছর জলপূর্ন থাকে। কথিত আছে যে উত্তরের কংসাবতী নদীর সাথে যোগ রয়েছে এই গম্ভীরার ।
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী সুভাষ চন্দ্র বসু, সোমেশ্বর শর্মা (পুরোহিত)—মালঞ্চ। শিবপ্রসাদ ঘোষ, খরিদা।
পথনির্দেশঃ ৬ নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের চৌরঙ্গী (মেদিনীপুর-খড়গপুর ক্রসিং) থেকে পশ্চিমে ৫ কিমি পার হয়ে সাহাচক। সেখানে বাম হাতে কয়েক পা দূরেই মন্দির।