নিজস্ব সংবাদদাতা: মাঝখানে মাত্র একটা রাত তারপরই নির্বাচন। বিধানসভার পর সবচেয়ে বড় লড়াই পৌর নির্বাচন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ১০৮ সভায় পাড়ায় পাড়ায় লড়াই। বাড়ির কর্তারা এই সময় একটু ছাড় পান খবর দেখার। পারমুটেশন আর কম্বিনেশনের শেষ বেলায় কে কোথায় এগিয়ে। অন্যদিকে নাছোড়বান্দা গিন্নি মহলে জি-বাংলা, স্টার জলসায় মিঠাই, উমা, খুকুমণির মধ্যে জোরদার লড়াই। কিন্তু সে সব ফেলে গোটা শুক্রবার ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রেই মন পড়ে আছে পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ার গিরিশমোড়, নন্দকুমারের ভূঁইয়াখালি, মহিষাদলের তেরপেখ্যার মত অজানা গ্রামেরও।

একই অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়নগড় থানার বৈতা জনার্দনপুর, সবং, দাঁতন প্রভৃতি এলাকার গ্রাম। বাংলা থেকে ৫৬৮০ কিলোমিটার দূরে ইউক্রেনে আটকে রয়েছে দুই মেদিনীপুরের প্রায় ডজন খানেক ছেলে মেয়ে। এরা সবাই ডাক্তারি পড়তে গিয়েছেন। শুরু হয়েছে যুদ্ধ, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়ভ বা কিভ প্রায় অবরুদ্ধ। রাজধানীতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বোরিসপিলও রুশবাহিনীর কড়া নজরদারিতে।
বাংলা তথা ভারতের মত দেশে বেসরকারি কলেজ গুলোতে ডাক্তারি পড়ার খরচ মারাত্মক বেশি। শুধু টিউশন ফিজ গুনতে হয় প্রায় কোটি টাকা তার সঙ্গে থাকা খাওয়া আনুষঙ্গিক খরচ। আর ইউক্রেনে ওই টাকায় প্রায় ৩জনের ডাক্তারি পড়া হয়ে যায়। তাই মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির ছেলেমেয়েরা ইউক্রেনে ছোটেন। প্রতিবছর ভারত থেকে শতাধিক পড়ুয়া যায় ডাক্তারি পড়তে এরমধ্যে আবার বাংলার সংখ্যাটা যথেষ্ট ভালো। এখনও পর্যন্ত যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে দুই মেদিনীপুরেরই প্রায় ১২জন রয়েছেন। যুদ্ধের খবর ছড়ানোর পর তাই ওই পরিবারগুলিই শুধু নয়, গ্রাম কিংবা পাড়ার ছেলে যেখানে আছে সেই ইউক্রেনে কী হচ্ছে খোঁজ নিতে টিভিতে চোখ রাখছে অনেকেই।
সিরিয়াল কিংবা ভোটের খবরের চাইতেও তাই যুদ্ধের খবরই এখন এই সব অঞ্চলের চর্চায়। চায়ের ঠেক কিংবা মুদির দোকানেও আলোচনায় উঠে আসছে অমুকবাবুর ছেলে কিংবা মেয়ের আটকে থাকার ঘটনার কথা। মাত্র ২৪ ঘন্টাতেই অনেকেই ইউক্রেন, কিভ শব্দগুলির মত রপ্ত হয়ে গেছেন ‘বাঙ্কার’ শব্দটিতে। সেন্ট্রাল কিয়েভ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি লাগোয়া অ্যাকাডেমিকা টুপোলেভা স্ট্রিট লাগোয়া অ্যাপার্টমেন্টগুলির ভাড়া বাড়ি ছেড়ে ওই ছেলেমেয়েরা এখন যে ‘বাঙ্কার’ য়েই আশ্রয় নিয়েছে।
বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন টারনোপিল স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরাও।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি জানিয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে জেলার ৬ জন ডাক্তারি পড়ুয়া আটকে পড়েছে বলে খবর মিলেছে। শুক্রবার জেলা প্রশাসনের তরফে তাঁদের পাসপোর্ট নম্বর, ঠিকানা সহ বিস্তারিত তথ্য নবান্নে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নন্দকুমার থানার ভুঁইয়াখালি গ্রামের অর্ণব মান্না এবং মহিষাদল থানার তেরপেখ্যা গ্রামের দেবজিৎ বর্মন ছাড়াও ইউক্রেনে আটক তমলুক থানার টাউন পদুমবসানের সোমশুভ্র ভৌমিক, উত্তর নারিকেলদার সোনিয়া ভৌমিক, মহিষাদল থানার লক্ষ্যার প্রীতম সামন্ত এবং হলদিয়ার দুর্গাচক থানার পানার দীপাঞ্জলি বেরা। সোমশুভ্র এবং সোনিয়া টারনোপিল স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির তৃতীয় এবং দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া। সোমশুভ্রের বাবা বাসুদেব ভৌমিক তমলুক পুরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের তৃণমূল সভাপতি। তিনি বলেন, ‘ছেলে যেখানে আছে এখনও সেখানে কোনও হামলা হয়নি। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ইউনিভার্সিটির তরফে কলেজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।’ সোনিয়ার বাবা দেবতোষ ভৌমিক বলেন, ‘ সকালেই কথা হয়েছে মেয়ের সঙ্গে।টারনোপিলে এখনও যুদ্ধের কোনও প্রভাব পড়েনি। পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় জল মজুত রাখতে বলেছি।’ কিয়েভ মেডিক্যাল ইউনিভর্সিটির চতুর্থ ও ষষ্ঠবর্ষের পড়ুয়া প্রীতম এবং দীপাঞ্জলি। প্রতিমের বাবা স্কুল শিক্ষক পরিমল সামন্ত বলেন, ‘ ছেলের আটকে থাকার কথা ডিএম এসপি এবং নবান্নে জানিয়েছি। নবান্ন থেকে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে।’ দীপাঞ্জলির বাবা ভোলানাথ বেরা বলেন, ‘মেয়ে খুব কষ্টে আছে। বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছে। ভয়ে কান্নাকাটি করছে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ সুস্থভাবে মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে দিন।’
অন্যদিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের বাসিন্দা সুশোভন বেরা বলেছেন, সুশোভন জানিয়েছেন, ‘গতকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার রাতে শুধু এক প্যাকেট ম্যাগি খেয়েছি। তারপর শুক্রবার সকাল ১০টা মানে এখনও অবধি আর কিছুই জোটেনি।’ বেলদা থানার গড়হরিপুরের বাসিন্দা অনন্যার এবার সেকেন্ড ইয়ার। অনন্যা সেন্ট্রাল কিয়েভ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। প্রচন্ড উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন
অনন্যার বাবা অশোক পাইক ও মা অপর্ণা সিকদার পাইক। জানিয়েছেন, ‘সবচেয়ে সমস্যা হল ওরা যে সুড়ঙ্গ বা বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে মারাত্মক ঠান্ডা। কোনও রকমে ভাড়া বাড়ি থেকে ওখানে গিয়েছে। তাড়াহুড়োতে পর্যাপ্ত পোশাক নিয়ে যায়নি। তার সঙ্গে খাবার ও পানীয় জলের মারাত্মক অভাব। জানিনা শেষ অবধি কি হতে চলেছে। নারায়নগড়ের বৈতা জনার্দনপুরের মেয়ে অনিন্দিতাও সেন্ট্রাল কিয়েভ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। ওর সিক্স্থ ইয়ার। আর চারমাসের মধ্যেই চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা হয়ে পাঠ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অনিন্দিতা বলেছেন, ” আমাদের ১৬ তলা আ্যপার্টমেন্ট ছেড়ে দেড়কিলোমিটার দুরে অন্য একটি বাড়ির নিচের বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছি। দিনের বেলায় গোটা কিয়ভেই কার্ফূ্ চলছে। দোকানপাট বন্ধ খাবার কোথায় পাব জানিনা।”
শেষ পাওয়া খবর অবধি মোট ২টি বিমান রওনা দিয়েছে ইউক্রেনে আটকে থাকা ৪৩০ জন ভারতীয় পড়ুয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। শুক্রবার রাত ৯টা নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান দিল্লি থেকে বুখারেস্টের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। অন্যটি রাত ১০টা ৪৫ নাগাদ রওনা দেয়। আধিকারিক সূত্রে জানা গিয়েছে শনিবার আরও দু’টি বিমান রওনা দেবে। আধিকারিকদের মতে বৃহস্পতিবার থেকে ইউক্রেন অসমারিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। সে কারণে বুখারেস্ট দিয়ে বিমান ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এক ভারতীয় আধিকারিক জানিয়েছেন, বিদেশমন্ত্রকের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার দু’টি বিমান রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট যাবে। সেখান থেকে ভারতীয়দের দেশে ফেরানো হবে। দূতাবাস থেকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সড়ক পথে ইউক্রেন-রোমানিয়া সীমান্তে পৌঁছতে। সেখানে যারা পৌঁছেছেন তাঁদের ভারত সরকারের আধিকারিকরা বুখারেস্টে নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে তাঁদের বিমানে তুলে দেওয়া হবে।