নিজস্ব সংবাদদাতা: যিনি একাধিক ধর্ষণ এবং খুনের দায়ে দোষি সব্যস্ত হয়ে জেল খাটছিলেন তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে জেড প্লাস ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিয়ে ভোটের কাজ করিয়েছে বিজেপি। এমনই অভিযোগ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পাতিয়ালার বাসিন্দা পরমজিৎ সিং সাওলি।

উল্লেখ্য গত ৭ই ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত ওই ঘৃণ্য অপরাধী যিনি কিনা তাঁর কন্যা সম শিষ্যাদের লাগাতার ধর্ষণে প্রমাণিত প্রায় ২১ দিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি পান হরিয়ানা ও পাঞ্জাব সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। যেখানে হরিয়ানা সরকার আদালতে উল্লেখ করেছিল যে, রাম রহিম তেমন ‘মারাত্মক অপরাধী’ নয় বলে। আর তার জেরেই প্যারোল পান রাম রহিম।
ঘটনাটি বিজেপির প্রকৃত চরিত্রকে উন্মোচন করেছে বলে বিরোধীরা বলেছেন, ‘বিজেপি সরকার, দল, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিকে নারী সুরক্ষার কথা বলে ভোট ভিক্ষা করছেন, অন্যদিকে এক ধর্ষক খুনিকে প্যারোলে শুধু ছাড়ছেন না, তাঁর জেড প্লাস সিকিউরিটিরও বন্দোবস্ত করছেন। এটাই বিজেপি।
ফলও হাতে নাতে, জেল থেকে বেরিয়েই বাবা রাম রহিম জানিয়ে দিয়েছে, ডেরা সচ্চা সওদার শিষ্যরা নির্বাচনে, বিজেপি, অকালি দল আর বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসীদের ভোট দেবে৷ কেবল ভোট পাবার জন্য এক জঘন্য অপরাধী প্যারোল পেল৷ জেড প্লাস সিকিউরিটি পেল।’
আসলে রামরহিম শুধুমাত্র দুটো খুন এবং দুটো ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত নন, আদালত তাকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ তিনি দুটো খুনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন৷ ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন৷ সেই ডেরা সচ্চা সওদার বাবা রাম রহিমকে, জেড প্লাস সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে৷ পঞ্জাব নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন তাঁকে প্যারোলে ছাড়া হয়৷ ওই ৭ ফেব্রুয়ারিতেই তাঁকে জেড প্লাস সিকিউরিটি দেওয়া হয়৷
তাঁকে যে জেড প্লাস নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে এটা অস্বীকার করেনি হরিয়ানা সরকার। হরিয়ানার প্রধানমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলেন, ” এটা সরকারের কর্তব্য যে জেল খাটা আসামীই হোক আর জেলের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষই হোক তাঁর জীবন সংশয় হলে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া। কিছু নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই রামরহিমকে জেড প্লাস নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল।”
রামরহিমকে প্যারোলে জেলের বাইরে আনার জন্য হরিয়ানা সরকারের আ্যডভোকেট জেনারেল যে হলফনামা দিয়েছিলেন সেখানে রামরহিমকে জেলে থাকা একজন ভালো ব্যবহার করা কয়েদি বলে উল্লেখ করার পাশাপাশি তাঁকে ‘তেমন বিপজ্জনক নয়’ গোত্রের আসামী বলা হয়েছিল। উল্লেখ্য রোহতকের সুনারিয়া জেলে বন্দি রামরহিমকে ২০০২ সালের দুটি ধর্ষণ ও দুটি খুনের মামলায় দোষি সব্যস্ত করে যাবজ্জীবনের পাশাপাশি একটি ২০বছরের কারাদণ্ডের সাজা শোনানো হয় এবং বলা হয় একটি সাজার মেয়াদ শেষ হলে অন্যটি শুরু হবে। ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে এই সাজা শোনানোর পর এই মামলায় আরেক দোষি সব্যস্ত হওয়া আসামী তাঁর পালিত কন্যার সাথে একই জেলে রাত্রিবাসের আবেদন করেছিলেন রামরহিম। যদিও আদালত সেই দাবি নাকচ করে দেয়। সেই থেকেই জেলে ছিলেন তিনি।
২০০২ সালে একটি চিঠি রামরহিমের ডেরা থেকে বাইরে চলে আসে যেখানে এক যুবতী ভক্ত অভিযোগ জানান যে তাঁকে ধর্ষণ করা হত, অত্যাচার করা হত রোজ৷ তিনি জানান বাবার ডেরায় এরকম আরও বহু মহিলা তাঁর মতনই ধর্ষিতা, নিপীড়নের শিকার। তাঁর চিঠি ছাপা হয়, সিরসা থেকে প্রকাশিত এক পত্রিকা পুরা সচ এ৷ সাংবাদিক, সম্পাদক রাম চন্দর ছত্রপতি এ নিয়ে লিখতে থাকেন৷ সিবিআই তদন্ত শুরু হয়৷ এরই মধ্যে খুন হন সাংবাদিক রাম চন্দর ছত্রপতি৷ সিবিআই গ্রেফতার করে রাম রহিম বাবাকে, বিপুল সম্পত্তি, ভোগ বিলাসের বিরাট ছবি সামনে আসে৷ ১২ বছর মামলা চলার পরে, ২০১৭ সালের ২৫ অগস্ট, সিবিআই রায়দানের দিন ঠিক করে, সেদিন প্রায় ৪০০ গাড়ির কনভয়ে রাম রহিম রোহতক জেল থেকে পঞ্চকুলা সিবিআই আদালতে আসে, ধর্ষণের মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, সেদিন দাঙ্গা বাঁধায় তার সমর্থকেরা৷ ৩৬ জন মারা যায়৷ একে ৪৭ থেকে রিভলবার, পিস্তল ব্যবহার হয়৷ পুলিশ তার কিছু উদ্ধারও করে৷ অসংখ্য বাস, স্কুল ভ্যান, সংবাদ মাধ্যমের ও বি ভ্যান জ্বালানো হয়, দোকান পোড়ে। পরে হিসেব বলছে ১০০ কোটির বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেদিন৷
২০১৭ সালের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে সাংবাদিক রাম চন্দর ছত্রপতির খুনের ষড়যন্ত্রেও অভিযুক্ত বলে রায় দেয় আদালত৷ ২০ বছরের জেল হয়। সেই খুনী ধর্ষক রাম রহিম, আজ জেড প্লাস সিকিউরিটি পাচ্ছে৷ দিচ্ছে বিজেপি সরকার। কারা পায় জেড প্লাস সিকিউরিটি ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, অমিত শাহ, রাজনাথ সিংয়ের মতো মোট ৪০/৪৫ জন এই জেড প্লাস সিকিউরিটি পায়। জেড প্লাস সিকিউরিটি মানে? ১০ জন এর বেশি এনএসজি কমান্ডো সহ মোট ৫৫ জনের সুরক্ষা বলয়৷ খরচ? আজকের দিনে ২৪ লক্ষ টাকা প্রতি মাসে৷ মানে ৮০ হাজার টাকা প্রতিদিন৷ একজন ধর্ষণের দায়ে হত্যার ষড়যন্ত্রে সামিল হবার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া মানুষের জন্য, ধর্ষক খুনি রাম রহমের জন্য৷ চিন্তাও করা যায়?
বিরোধীরা বলছেন, যে দলের নেতা বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও বলে জনসভায় হাঁক পাড়েন, যে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক জনসভায় নারী সুরক্ষার কথা বলে, সেই সরকার কেবল, কেবল ভোট পাওয়ার জন্য এতটা নীচুতে নামতে পারে, এটাই বিজেপি। কেবল জেড প্লাস সিকিউরিটি দেওয়া নয়৷ তাঁকে প্যারোলেও ছাড়া হয়েছে৷ উল্লেখ্য রামরহিম নাকি জেলের বাইরে থেকে তাঁর ভক্তদের জন্য একটি কোড নম্বর পাঠিয়েছেন আর সেই কোড তাঁর শিষ্যরা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তদের কাছে যারমধ্যেই রয়েছে বিজেপিকে ভোট দানের সঙ্কেত। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট এই সক্রান্ত মামলাটি শুনতে রাজি হয়েছেন। আগামী সোমবার সেই শুনানি হতে চলেছে যদিও রবিবারই শেষ হয়ে যাচ্ছে পাঞ্জাবের ভোট।