Sunday, May 12, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১৬৩ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
শীতলানন্দ শিব মন্দির, হরিরামপুর                          (দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)চিন্ময় দাশকংসাবতী হোল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রধান নদী। এর পরেই যে নদীর স্থান, তার নাম—শিলাবতী। জেলার উত্তর-পূর্ব অংশের সমাজ ও অর্থনীতিতে তার অপরিসীম অবদান। দাসপুর থানা এই দুই নদীর জলধারায় পুষ্ট। এই থানার ভূভাগ বহুকাল যাবত অতি উর্বর। ফলে, কৃষিজ সম্পদের উতপাদন ও বাণিজ্যে সমগ্র থানা অতীত কাল থেকেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। বহু ধনাঢ্য পরিবারের বসতি হয়েছিল এই ভূভাগে।
পরে পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল রেশম শিল্প। এই শিল্পের আকর্ষণে আর্মেনিয়ান, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ বণিকেরা এসে হাজির হয়েছিল সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। সরাসরি দাসপুরের মাটিতে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল তাদের অনেকেই।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

এই হরিরামপুরের অদূরেই গুড়লি আর সুরতপুর গ্রাম। চিরবহমান শিলাবতীর কোলেই গড়ে উঠেছে এই দুটি জনপদ। এখনও সেখানে দেখা যায়, বিদেশীদের ফেলে যাওয়া, চিমনী সহ তিন-চারটি রেশমকুঠি। সেখানে শিলাবতীর তীরে আছে প্রাচীন জাহাজঘাটা। ‘সাহেবঘাটা’ নামেই আজও তার পরিচয়।
রেশম শিল্প থেকে বিদেশীরাই কেবল পুষ্ট হয়েছিলেন, তাই নয়। স্থানীয় বহু মানুষ বা পরিবারও অর্থসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। কেউ জমিদারীও গড়ে তুলেছিলেন। আর জমিদারদের প্রধান আকাঙ্ক্ষা থাকে, জীবদ্দশায় একটি দেবালয় নির্মাণ করে যাওয়া।
একটি জমিদারী গড়ে উঠেছিল হরিরামপুরের আদকবংশের হাতেও। হরিরামপুর, গুড়লি, আনন্দগড়, পলতাবেড়িয়া, পাকুড়দানা ইত্যাদি মৌজায় ছড়িয়ে ছিল তাঁদের জমিদারি মহাল। সেই বংশের একেবারে শেষ প্রজন্মে, জনৈক গিরিধর আদক মহাদেব শিবের একটি মন্দির গড়েছিলেন। গিরিধর অপুত্রক ছিলেন। ফলে, দেবালয় সহ তাঁর বিষয়-আশয় ‘মণ্ডল’ পদবীর দৌহিত্রের অধিকারে গিয়েছিল। সেই মণ্ডলবংশই মন্দির পরিচালনা করে আসছেন। তবে, কালে কালে, গ্রামবাসীগ্ণও এই কাজে যুক্ত হয়েছেন।
কোন প্রতিষ্ঠা ফলক নাই মন্দিরে। তবে, পূর্ববর্তী পুরাবিদগণ মন্দিরটির স্থাপত্য বিচার করে বলেছেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি নির্মিত হয়ে থাকবে।
চার-চালা রীতির পশ্চিমমুখী মন্দিরটি ইটের তৈরি। স্বল্পোচ্য পাদপীঠ। একটি প্রদক্ষিণ-পথ বেষ্টন করে আছে সেটিকে। গর্ভগৃহের সামনে একটি অলিন্দ, সেটি খিলানের তিন-দুয়ারী। খিলানগুলি ‘হাঁসগলা’ রীতির। বাংলা ১৩৪২ সনে, সংস্কার কাজের সময়, মন্দিরের থামগুলির গড়ন বদল হয়ে গিয়েছে। পূর্বের আদি রূপের বিবরণ দেওয়া আজ আর সম্ভব নয়।
অলিন্দটির ভিতরের ছাদ বা সিলিং টানা-খিলানের। গর্ভগৃহের সিলিং রচিত হয়েছে, পরস্পর বিপরীত দেওয়ালে, চারটি খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে।
মন্দিরের শীর্ষক বা চুড়াটি বর্তমানে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত।
এই মন্দিরের খ্যাতি ও গৌরব, এর টেরাকোটা ফলকের সমাবেশ। সামনের দেওয়াল জোড়া ফলক বিন্যাস করা। ফলক আছে ঃ ১ তিনটি দ্বারপথের মাথায়, তিনটি বড় প্রস্থে; ২ কার্ণিশের নীচ বরাবর ৩টি সমান্তরাল সারিতে; ৩ দু’দিকের কোণাচ অংশে দুটি খাড়া সারিতে। এছাড়াও, গুটি তিনেক ফলক রয়েছে উত্তরের দেওয়ালেও।
এই নিবন্ধের পরিসর অতি সংক্ষিপ্ত। সব ফলকের এখানে ঠাঁই হবে না। আমরা বরং মুখ্য ফলকগুলির বিষয় বিন্যাস করে, উল্লেখ করে রাখি। তাতে, এক লহমা চোখ বুজে, কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারবে, হয়তো বা।
মুখ্য কয়েকটি ভাগ হতে পারে ফলকগুলির—১. পুরাণ কথা, ২. রামায়ণ কাহিনী, ৩. কৃষ্ণলীলা, ৪. মঙ্গলকাব্য এবং ৫. বিবিধ।
১. পুরাণ কথার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হোল বিষ্ণুর দশাবতার। হেন মন্দির নাই, যেখানে এই মোটিফ রূপায়িত হয়নি। সাধারণত দেওয়ালের দু’দিকের কোণাচ অংশেই এটি রূপায়িত হয়। এখানেও তাই হয়েছে।
আছে চতুরানন ব্রহ্মা, নাগ-কোমরবন্ধনী যুক্ত মহাদেব শিব ইত্যাদি একক ফলক।
এছাড়াও আছে—মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা দুর্গা। বিষ্ণুর অনন্তনাগ শয্যা। একটি বিশিষ্ট ফলক আছে এই মন্দিরে—মহাদেব শিব তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র গণেশকে কোলে নিয়ে উপবিষ্ট।
২. মন্দির অলঙ্করণে রামায়ণ কাহিনীও একটি জনপ্রিয় বিষয়। রাবণের সীতা হরণ, জটায়ুর রাবণকে বাধা দান, অশোককাননে বন্দিনী সীতা, রাম-রাবণের লঙ্কা-যুদ্ধ, সীতাদেবী সহ রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক রূপায়িত হয়েছে এখানে।
৩. টেরাকোটা ফলকসজ্জা হয়েছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ নেই, এমন মন্দির দেখা যাবে না। শিশুকাল থেকে যৌবন—কৃষ্ণের বিচিত্র লীলা কাণ্ড আসমুদ্র-হিমাচল হিন্দুর কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় বিষয়। এ মন্দিরে কালীয় দমন এবং গোপিনীদের নিয়ে কৃষ্ণের নৌকাবিলাস বেশ উল্লেখযোগ্য।
৪. মঙ্গল কাব্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় ধনপতি সওদাগরের কমলে কামিনী দর্শন। এখানেও রূপায়িত হয়েছে মোটিফটি।
৫. অন্যান্য অনেকগুলি ফলকের কথাও বলা দরকার। উত্তরের দেওয়ালে উদবাহু হয়ে নৃত্যরত শ্রীগৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ প্রভু, পত্নীকে সামনে নিয়ে ভার কাঁধে এক পুরুষ; গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’পাশে দুটি দ্বারীমূর্তি; অনেকগুলি ময়ুর, ঘোড়ায় টানা রথ, ব্যাজনরত অনেকগুলি নারীমূর্তি ইত্যাদি।
দুটি ফলক বিশেষ উল্লেখের দাবীদার—উত্তরের দেওয়ালে অর্ধোন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে প্রিয়তমের জন্য প্রতিক্ষারত একটি দ্বারবর্তিনী মূর্তি আছে। এর সাথে, সামনের দেওয়ালে, নীচের কার্ণিশ জুড়ে, একটি সারিতে পনেরটি নিবেদন মন্দির বা প্রতিকৃতি দেউল। প্রতিটি দেউল ত্রি-রথ এবং পীঢ় বিভাজন করা। প্রত্যেকটির অভ্যন্তরে একটি করে শিবলিঙ্গ রচিত আছে।
মন্দিরের সামনে পুরাতন একটি আট-চালা নাট্মন্দির আছে, টিনের ছাউনি দেওয়া। দাসপুর-নাড়াজোল রাজপথের গায়েই এ মন্দির। রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে নাট্মন্দিরে অংশবিশেষকে ভেঙ্গে ফেলে। তাতে, অঙ্গহানি ঘটেছে দেবস্থলিটির।
টেরাকোটা মণ্ডিত মন্দিরটি বর্তমানে ভয়ানক জীর্ণতার শিকার। অবিলম্বে এটির সংস্কার এবং সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রশাসন, জেলা বা রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ, কিংবা কোনও অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারেন। নইলে, একটি হেরিটেজ স্থাপত্য বিনষ্ট হয়ে যাবে সকলের চোখের সামনেই।
তখন ইতিহাস কিন্তু ক্ষমা করবে না আমাদের কাউকেই।
সাক্ষাতকারঃ সর্বশ্রী বিশ্বনাথ মণ্ডল, পরেশ নাথ মণ্ডল, রণজিত মণ্ডল, সুজিত মণ্ডল, তপন ঘোষ—হরিরামপুর।
সহযোগিতাঃ শ্রী মানব দাস মহাপাত্র—খড়গপুর শহর। শ্রী তাপস ঘোষ—হরিরামপুর।
পথ-নির্দেশঃ দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের পাঁশকুড়া থেকে ঘাটালগামী পথের বকুলতলা হয়ে, নাড়াজোল্মুখী পথের উপরেই মন্দিরটি অবস্থিত। মেদিনীপুর শহর থেকে কেশপুর নাড়াজোল হয়ে বকুলতলামুখী পথেও পৌঁছানো যাবে।

- Advertisement -
Latest news
Related news