Wednesday, May 22, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১৯।। গোবর গোহ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

দেশপ্রেমিক মল্লবীর
গোবর গোহ বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

১৩ এপ্রিল ১৯১৯। পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের পাঁচিল ঘেরা বদ্ধ উদ্যানে সমবেত জনতাকে গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয় কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার রেগিনান্ড ডায়ার। পৈশাচিক এই ঘটনার অভিঘাতে পরাধীন দেশ শোকস্তব্ধ। জাতীয় কংগ্রেস কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মানবতার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ প্রথম প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন। ত্যাগ করলেন নাইটহুড উপাধি। লন্ডনে, এক বাঙালী তরুণ প্রকাশ্য সভায় রবীন্দ্রনাথের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা করেন। এই অসমসাহসী দেশপ্রেমিক তরুণটির নাম মল্লবীর গোবর গোহ (১০মার্চ ১৮৯২–২ জানুয়ারি ১৯৭২)।

আসল নাম যতীন্দ্র চরণ গুহ। সদ্যজাত ছেলেটি এত বিশাল বপু ছিল যে, ডাক্তাররা তার বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। কুস্তিগির ঠাকুরদা অম্বিকাচরণ (অম্বু গোহ ) আদর করে ডাকতেন গোবর গণেশ বা গোবরের ডেলা। কলকাতার মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে জন্ম গোবরের। বাবা রামচরণ, মা – নির্মলা কুমারী দেবী। সেকালের মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর পড়াশুনার জন্য চলে যান ইংল্যান্ডে। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন। পরে ডাকযোগে আমেরিকা থেকে সমাজবিজ্ঞান ,মনোবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন।

সংস্কৃতিপ্রেমী গোবর গোহ ভারতীয় রাগ সংগীতের উপর তালিম নিয়েছেন দীর্ঘদিন। নিয়মিত সেতার বাজাতেন। বার্নার্ড শ ও অস্কার ওয়াইল্ড ছিলেন তাঁর প্রিয় সাহিত্যিক। এবং অবশ্যই অন্যান্যদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ। নিখুঁত উচ্চারণে সাহেবদের মুলুকে দিনের পর দিন সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন ইংরেজিতে। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী নিয়ে আয়োজিত সভাগুলোতে তাঁর কথা শুনতে অর্থ ব্যয় করে মানুষ সমবেত হতেন। নিউ ইয়র্কের ‘মর্ডান আর্ট এন্ড লেটার্সে’ আয়োজিত একটি সভাতো ইতিহাস প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এক মল্লবীরের মগজ নিঃসৃত মেধাবী ও তীক্ষ্ণ এবং মননশীল আলোচনার জন্য সাহেবরা এই সুবিনীত মানুষটিকে আদর করে দ্য ‘জেন্টল জায়েন্ট’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন ।

কলকাতার নাম করা ধনী বংশে জন্ম গোবরের। তাঁর জ্যাঠামশায় ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগির খেতু গোহ (ক্ষেত্র চরণ গুহ )। অকালে প্রয়াত হন তিনি। ফলে বংশ পরম্পরায় কুস্তির চর্চা ও মর্যাদা অটুট রাখতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে সাহিত্য সংস্কৃতি প্রেমী যতীন্দ্রকে আখড়ায় নামিয়ে দেন বাবা রামচরণ। বাবা -কাকার প্রশিক্ষণ ছাড়াও কুস্তির নানা প্রশিক্ষণে দেশ খ্যাত মল্লবীরেরা গোবর গোহকে তালিম দিয়েছেন। অমৃতসরের খোসলা চৌবে , লাহোরের ওস্তাদ বগলা খলিফার নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কল্লুর শাগরেদ গুর্তা সিং এবং রহমানি পালোয়ানের কাছে প্রশিক্ষিত হয়েছেন গোবর।

আপাদমস্তক শৌখিন এই বাঙালী যুবক বাহারি পাগড়ি ,সূক্ষ্ম কাজের কাশ্মীরি শাল, ফতুয়া এবং ধুতি পরিধান করতেন। অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে সভা সমাবেশ এবং প্রকাশ্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাথায় গান্ধী টুপি শোভা পেত। তাঁর অন্যতম নিকট প্রতিবেশী ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানী আচার্য্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি প্রায়শঃ সন্ধ্যায় সময় করে হাজির হতেন গোবরের আড্ডায়। চা ও জলখাবারের দেদার আয়োজন থাকত। হাভানা চুরুটের ম ম গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যেত পরিবেশ। ছেলে রতনকে দেখিয়ে আচার্য্য সত্যেন্দ্রনাথকে বলতেন গোবর গোহ -‘ওর মগজে একটু অঙ্ক কষে দিন তো ‘! হেসে উঠতেন এস্রাজ -শিল্পী বিজ্ঞানী। মেতে উঠতেন তন্ত্র সাধনায়।

১৯১০ সালে প্রথমবার ইউরোপে গিয়ে তিনমাস কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন গোবর। বছর দুয়েক পরে তেজী তরুণ যখন ইউরোপে পাড়ি দিলেন বিলিতি কাগজ গুলিতে তার ধারাবাহিক বিবরণ ছাপা হয়েছে। কলকাতায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকা সেই সব রোমাঞ্চকর খবর লাগাতার প্রকাশ করেছে –“গোবর ভারতের অন্যতম বালক পালোয়ান। তাঁর ওজন তিন মণ। কিন্তু দুই মণ ওজনের একটা হাঁসুলী গলায় পরে”(Who wears a Collar 160 Ibs in weight. )
যখন বিশ বছর তাঁর বয়স , তখন ওজন ২৩০ পাউন্ড। গলা ২০ ইঞ্চি, হাতের গোছা ১৫ ইঞ্চি , কবজি পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুক ৫৬ নয় ৫০ ইঞ্চি, ফুলিয়ে ৫২ ইঞ্চি। ঊরু -৩৩ ইঞ্চি এবং পায়ের ডিম সাড়ে ১৮ ইঞ্চি। মুখমণ্ডলে অপরূপ এক প্রশান্তি ফুটে উঠত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল , গোবর গোহের চোখদুটি অপূর্ব সুন্দর। তাঁর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত ছিল। দেহের শক্তি বাড়ানোর জন্য তাঁর খাবারে মেশানো হত রজত চূর্ণ ও স্বর্ণ চূর্ণ। ১৯৩৬ সালে ১৯ নম্বর গোয়াবাগান স্ট্রিটে নিজের আখড়া স্থাপন করেন। সেখানে টালির চৌচালা আখড়ার গায়ে বিশাল খাটাল বানিয়ে তোলেন। সেই খাটালে ৪০টি গাভী ও ৩০ টি ছাগীর দুগ্ধ সশিষ্য সেবন করতেন ।

বিলেতে থাকবার সময় গোবর গোহ ব্যক্তিগত পাচকের রান্না ছাড়া বিলিতি খাদ্য কখনো স্পর্শ করেননি। তাঁর প্রিয় খাদ্য ছিল নানা পাখির মাংস ও মাখন। বাদাম ও চিনি সহ নানা দানা শস্য মিশিয়ে সুস্বাদু শরবত খেতেন নিয়মিত। সাথে সাথে চলত শরীর চর্চা। সাথী দুজোড়া মুগুর। এক জোড়ার প্রত্যেকটি পঁচিশ সেরের। আর এক জোড়ার প্রত্যেকটির ওজন ছিল পঞ্চাশ সের। মল্লগুরু হিসেবে গোবর গোহ কুস্তির কিছু মোক্ষম প্যাঁচ আবিষ্কার করে শিষ্যদের মধ্যে কৌশল প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। সেগুলোর নাম ও রোমাঞ্চকর– ধোঁকা ,ঢিব্বি, গাধানোট ,ঢাক ,টাং ,পাট , ধোবাপাট, কুল্লা ,নেলসান এবং রদ্দা। এর মধ্যে রদ্দা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল তাঁর।

বিদেশে প্রথম স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত মল্লবীর জিমি ক্যাম্বেলকে পরাস্ত করে স্কটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন গোবর গোহ। দিনটা ছিল ২৭ আগস্ট ১৯১৩। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর এডিনবরার অলিম্পিক বিজয়ী জিমি এসেনকে ৩৯ মিনিটে ধরাশায়ী করে দখলে নেন চ্যাম্পিয়নশিপ অব্ ইউনাইটেড কিংডম পদক। একটি প্রতিযোগিতাতেই আয় করেন দেড় হাজার পাউন্ড সহ খেতাব। এছাড়া টিকিট বিক্রির ৭০%শতাংশ অর্থ বিজয়ী হিসেবে অর্জন করেন তিনি। প্যারিসের নেভো সার্ক টুর্নামেন্টে ইউরোপের তাবড় তাবড় কুস্তিগিরকে পরাস্ত করেন তিনি। একে একে গ্রিসের বিল দেমত্রালস, জার্মানির কার্ল জাফট , বোহেমিয়ার জো শুলজ, বেলজিয়ামের জনসন , সুইডেনের লুনডিন ,হল্যান্ডের হকি ড্রাক, বুলগেরিয়ার গ্রানোভিচ এবং তুরস্কের মেহমুদকে পর্যুদস্ত করেছিলেন এই বাঙালী মল্লবীর ।

১৯১৫ সালের পরে স্বদেশে থিতু হন গোবর গোহ। বিশ্বজোড়া নামডাক তখন তাঁর। বংশ পরম্পরায় চলে আসা কুস্তির আখড়াগুলো তখন সশস্ত্র বিপ্লবীদের মহলা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বাঘা যতীন, হেম কানুনগো, বারীণ ঘোষ, ক্ষুদিরাম ,মাস্টারদা সূর্য সেন কত শত বীর সেনানী শরীর চর্চার আড়ালে স্বাধীনতার বীজ মন্ত্র দান করে চলেছেন। ইংরেজ শাসককে ধোঁকা দিতেই তখন কুস্তিকে ক্রীড়া তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে দিকে দিকে ।গোবরের আখড়ায় নিয়মিত শরীর চর্চা করতে আসতেন কবি ও অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মহাত্মা গান্ধীর একান্ত সচিব নির্মল কুমার বসু। তাঁর আখড়ায় অন্যান্য বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে স্মরণীয় নাম সংগীত শিল্পী মান্না দে ,ব্যায়াম বীর মনোহর আইচ, মনতোষ রায়, বিষ্ণুচরণ ঘোষ এবং ১৯৫২ অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী খাশাবা দাদা সাহেব যাদব ।

ছাত্রদের তিনি বলতেন একজন কুস্তিগিরের ত্রিশক্তি হল — উপস্থিত বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা ও কৌশল। আটাত্তর বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন গোবর গোহ। তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে গোবর স্মরণে স্মৃতিগ্রন্থ প্রকাশ করেন তাঁর সুহৃদ আচার্য্য বসু। স্মৃতি তর্পণে বলেন -‘ডন কুস্তি করেও যে সেতার বাজানো যায়, তার প্রমাণ গোবর গোহ’।★

- Advertisement -
Latest news
Related news