Wednesday, May 1, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০০।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশশান্তিনাথ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর,
(চন্দ্রকোণা শহর, পশ্চিম মেদিনীপুর) মান্য ইতিহাসে দেখা যায়, এক সময় কেতুবংশ রাজত্ব করতো চন্দ্রকোণায়। বলা হয়, চন্দ্রকোণা নামের উৎপত্তি হয়েছিল চন্দ্রকেতু রাজার নাম থেকে। কেতুবংশের পাঁচ পুরুষের দেড়শ’ বছরের শাসন উৎখাত করে, জনৈক বীরভান ভানবংশের পত্তন করেছিলেন। ভানবংশের শেষ রাজা ছিলেন মিত্রসেন। একটি মাটির দুর্গ গড়েছিলেন তিনি। সেই থেকে এলাকাটির নাম হয়—মিত্রসেনপুর। ১৮৬৯ সালে ইংরেজের হাতে চন্দ্রকোণা পৌরসভা গঠিত হলে, মিত্রসেনপুর একটি ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। এক সময় সূতি, পাট আর রেশম বস্ত্র উৎপাদনের সুবাদে বয়নশিল্পের অভ্যুদয় ঘটেছিল চন্দ্রকোণা নগরীতে। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছিল কুটিরশিল্পের সম্ভার। এইসকল শিল্পসম্ভার বিকাশের সুবাদে, স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই ধনী হয়ে উঠেছিলেন। সামগ্রিকভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল চন্দ্রকোণা নগরীরও। 

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

পূর্বকালে একটি নগরীর মূল্যায়ণ করা হোত, তার অন্তর্ভুক্ত হাট, বাজার আর গলি-র সংখ্যা দিয়ে। চন্দ্রকোণা হোল ‘বাহান্ন বাজার আর তিপান্ন গলি’র শহর। এখানে মিত্রসেনপুর বাজার আর মিত্রসেনপুর গলি—দুটিই আজও বর্তমান আছে। এখানের এক-একটি  বাজার আবার অনেকগুলি পটি বা মহল্লায় বিভক্ত ছিল। দেখা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে, প্রতিটি পট্টির অধিবাসী জমিদারগণ বহু সংখ্যায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোথাও আবার কাছাকাছি অবস্থিত অনেকগুলি পট্টি, মিলিত উদ্যোগে, মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে।
আমাদের বর্তমান আলোচ্য, মিত্রসেনপুরের এই শান্তিনাথ শিব মন্দির, ১৮২৮ সালে, মিলিত উদ্যগে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-লিপিতেও, এই বিষয়ের উল্লেখ করা আছে। সেজন্য এই মন্দিরের প্রচলিত নাম— ‘বাইশ পট্টির মন্দির’।
ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি নব-রত্ন রীতিতে নির্মিত। পূর্বকালে ৭ ধাপ সিঁড়ি যুক্ত, ফুট পাঁচেক উঁচ্‌, ভিত্তি ছিল মন্দিরটির। সেই ভিত্তি বহুকাল হোল ভূমিগত হয়ে গিয়েছে।
সামনে তিন-খিলানের একটি অলিন্দ। টানা-খিলানের সিলিং সেটির। পিছনে এক-দ্বারী গর্ভগৃহ। সেটির সিলিং হয়েছে, তিন ধাপ খিলানের মাথায়, গম্বুজ রচনা করে।
রত্নগুলিতে বাঢ় ও গণ্ডী জুড়ে রথ-বিভাজন করা। গণ্ডী অংশে পীঢ় বিভাজনও করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হোল, কেন্দ্রীয় রত্ন ও উপরের চারটি রত্ন চতুষ্কোণ হলেও, নীচের চারটি রত্ন আট-কোণা (অক্টাগোনাল) হিসাবে নির্মিত হয়েছে।
শীর্ষক অংশগুলি বেঁকি, আমলক, খাপুরি, কলস এবং বিষ্ণুচক্র শোভিত হয়ে, বেশ সুদর্শন।
প্রচুর টেরাকোটা সমাবেশ হয়েছিল এই মন্দিরে। একেবারে পাদপীঠ সংলগ্ন, স্তম্ভগুলিতেও ফলকের বিন্যাস ছিল পূর্বকালে। মন্দিরের সংস্কার কাজের সময় স্তম্ভের গড়নটি যেমন বদল হয়ে গিয়েছে, মুছে গিয়েছে ফলকগুলিও।
বর্তমান ফলক দেখা যায়—১. তিনটি দ্বারপথের মাথায় তিনটি বড় প্রস্থে। ২. কার্ণিশের নীচে সমান্তরাল তিনটি সারিতে। ৩. সামনের দেওয়ালের দুই কোণাচ অংশের গায়ে চারটি করে সারিতে।
ফলকের মোটিফ নির্বাচিত হয়েছে মুখ্যত মহাভারত কাহিনী থেকে—পাণ্ডব ও কৌরবের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, ভীষ্মের শরশয্যা ও পিতামহের জন্য অর্জুনের পানীয়জল উত্তোলন, শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা গমণ এবং তা দেখে গোপিনীগণের বিলাপ, রাই-রাজা, শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা, শ্রীকৃষ্ণের নিকট রাধিকা গমনোদ্যতা—তা দেখে আয়ানের রাধার কেশাকর্ষণ ইত্যাদি।
কার্ণিশের নীচের সারিগুলিতে দু’জন গোপী সহ শ্রীকৃষ্ণের চারটি বড় আকারের ফলক। বীণা, মৃদঙ্গ, ঝম্প সহ চারটি বাদিকামূর্তিও নজর করবার মতো।
কার্ণিশের নীচের শেষ সারিতে তিনটি টানা-ফলক—১. রামায়ণ থেকে রামচন্দ্র ও সীতাদেবীর সিংহাসন আরোহন। ২. গোপিনীগণ পরিবৃত শ্রীকৃষ্ণ। ৩. জগাই-মাধাই, নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈত আচার্য্য সহ শ্রীগৌরাঙ্গের সংকীর্তন দৃশ্য।
কোণাচ অংশের সংলগ্ন সারিগুলিতে, ছোট ছোট চতুষ্কোণ খোপে, অজস্র ফলক। বিবিধ ফলক ছাড়া, বিষ্ণুর দশাবতার সহ  পৌরাণিক দেবদেবীগণও সেখানে রূপায়িত হয়েছেন।
পঙ্খের কাজও আছে মন্দিরে—১. দক্ষিণের দেওয়ালে চারপুত্র-কন্যা সহ শিব ও পার্বতী রূপায়িত হয়েছেন। ২. দ্বিতলের গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’দিকে, ভিনিশীয় রীতির অর্ধোন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে, প্রিয়জনের প্রতীক্ষারতা, দুটি দ্বারবর্তিনী মূর্তি। ৩. নীচে গর্ভগৃহের দ্বারলগ্ন নন্দী ও ভৃঙ্গীর দুটি মূর্তি।মন্দিরটি বেশ সযত্ন রক্ষিত। তবে, আবার জীর্ণতার গ্রাস শুরু হয়েছে। সেদিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। এছাড়াও, পরবর্তীকালে মন্দিরে বাজারি রাসায়ণিক রঙের ব্যবহার থেকে বিরত থাকাও জরুরী প্রয়োজন।
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী রঞ্জিত বিশুই, সঞ্জিত বিশুই, দিলীপ বিশুই—মিত্রসেনপুর।
সহযোগিতা—শ্রী গণেশ দাস—ঠাকুরবাড়ি, চন্দ্রকোণা শহর।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর, খড়গপুর, পাঁশকুড়া, চন্দ্রকোণা রোড কিংবা আরামবাগ—সব দিক থেকেই সরাসরি চন্দ্রকোণা পৌঁছানো যাবে। বাসস্ট্যাণ্ড থেকে অল্প দূরেই মিত্রসেনপুর।

- Advertisement -
Latest news
Related news