জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ রঘুনাথ মন্দির, শিরোমণি (কোতওয়ালি)মুঘল শাসনের শেষ পর্ব থেকে ইংরেজ শাসনের প্রথম পর্ব (১৭৪০ – ১৭৯০) পর্যন্ত, দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী সময়কাল বর্গী বাহিনীর আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়েছিল মেদিনীপুর জেলা। অবাধ লুন্ঠন, নরহত্যা, নারী-নির্যাতন তছনছ করে দিয়েছিল জেলার অধিবাসী সমাজকে। পরিত্রানের কোনও উপায় ছিল না।
সেই উৎপাতের সময় ঘাটাল থানার গোকুলনগর-মহারাজপুর গ্রাম থেকে একটি ব্রাহ্মণ পরিবার ভিটে মাটি ছেড়ে জঙ্গলখণ্ড এলাকায় চলে যাচ্ছিলেন।
চলার পথে মেদিনীপুর নগরী তখনও ক্রোশ চারেক দূরে। সূর্যদেব অস্তাচলে গেলেন। অগত্যা যাত্রাবিরতি ঘটিয়ে, রাত্রিবাসের জন্য রান্নার আয়োজন করতে লাগল পরিযায়ী দলটি।
প্রবাদে বলে— ‘নৃপ কর্ণেন পশ্যতি’। এলাকাটি কর্ণগড় রাজার মহাল এলাকা। রাজত্ব করছেন যশোবন্ত সিংহ। চুয়াড় বিদ্রোহখ্যাত রানি শিরোমণির শ্বশুর তিনি। রাজার চর রাতেই খবর তুলে দিল রাজার কানে।
সকাল না হতেই, রাজার পাইক এসে অকুস্থলে হাজির। পুরো দলটাকে নিয়ে হাজির করে দিয়েছিল রাজার দরবারে। দলকর্তা নিজেদের পরিচয় দিয়ে, উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করলেন রাজার কাছে। বক্তার পাণ্ডিত্য, ভাষার মাধুর্যে দরবার শুদ্ধ সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
যশোবন্ত সিংহ কেবল সুশাসক বা ধর্মপ্রাণ রাজাই ছিলেন না। গুণীর কদর করতেও জানতেন। পরিয়ায়ী দলটিকে ভূসম্পত্তি দিয়ে বসত করিয়েছিলেন নিজের মহালে, রাজধানি কর্ণগড়ের অদূরে, শিরোমণি গ্রামে। পাণ্ডিত্যের কারণে, ‘ভট্টাচার্য্য’ উপাধিও দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ বংশটিকে।
ঘাটালের গ্রামে থাকতে শিবের উপাসনা করত বংশটি। কৌলিক পদবী ছিল–‘চট্টোপাধ্যায়’। শিরোমণি গ্রামে সেই পদবী বদল করে, ‘ভট্টাচার্য্য’ পদবীর প্রবর্তন হয়েছিল বংশটির।
চৈতন্যদেবের কারণে, সতের-আঠার শতাব্দীতে বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবার্চনার প্লাবন তৈরি হয়েছিল সারা বাংলা জুড়ে। নবাগত পরিবারটিও শৈব-রীতি ছেড়ে, শিরোমণি গ্রামে বৈষ্ণবীয় ধারায় সেবাপূজার প্রচলন করেছিল বংশের জন্য। ভগবান বিষ্ণুকে আরাধ্য করে, ‘রঘুনাথ’ নামিত একটি শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিল কুলদেবতা হিসাবে।
পরবর্তীকালে বংশেরই জনৈক শ্যামাচরণ ভট্টাচার্য্য একটি মন্দির গড়ে, বিগ্রহগুলি স্থাপন করেছিলেন। ততদিনে দামোদর এবং মধুসূদন নামের আরও দুটি শালগ্রাম এবং শীতলা ও মনসা দুই দেবীরও অধিষ্ঠান হয়েছে বেদীতে।
উঁচু পাদপীঠের উপর দক্ষিণমুখী মন্দিরটি দালান-রীতিতে নির্মিত। সামনে একটি তিন-দ্বারী অলিন্দ এবং পিছনে এক-দ্বারী গর্ভগৃহ নিয়ে সৌধটি নির্মিত। সবগুলি দ্বারপথই দরুণ-রীতির খিলানের সাহায্যে নির্মিত হয়েছে। অলিন্দ এবং গর্ভগৃহের বাইরে উপরের ছাদ সমতল হলেও, এ দুটির ভিতরের সিলিং নির্মিত হয়েছে খিলানের সাহায্যে। অলিন্দের স্তম্ভগুলিতে ত্রি-রথ বিন্যাস দেখা যায়।
মন্দিরের শীর্ষক বা চুড়াটি নির্মিত হয়েছে সামনের দেওয়ালের আলসের মাথায়। পরপর পাঁচটি স্তম্ভ নির্মাণ করে, কেন্দ্রীয় স্তম্ভের মাথায় বেঁকি, আমলক, কলস এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত হয়েছে। এই স্তম্ভের দু’দিকে দুটি ব্যাদিতবদন সিংহমূর্তি রচিত।
তেমন কোন অলঙ্করণ নাই মন্দিরে। তবে, সরলরৈখিক কার্ণিশের নীচে দু’সারি এবং তিনটি দ্বারপথের মাথার তিনটি বড় প্রস্থে পঙ্খের উৎকৃষ্ট নকশার কাজ বেশ মনোরম।
শিরোমণি গ্রামে পথের পাশেই দেবী সিংহবাহিনীর একটি এক-রত্ন মন্দির আছে। সেটি দর্শনীয়।
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী অমলেন্দু ভট্টাচার্য্য, বনবিহারী ভট্টাচার্য্য এবং রাজেশ ভট্টাচার্য্য— শিরোমণি।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর শহরের পূর্বদিকে ৭/৮ কিমি দূরত্বে এই মন্দির। শহরের এল আই সি চক থেকে নিয়মিত অটোরিক্সা চলাচল করে, শহরের পূর্বপ্রান্তের বাইপাস রাস্তা ভেদ করে।