জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
দুর্গা মন্দির, চক নরসিংহ (ডেবরা, পশ্চিম মেদিনীপুর) অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় তখন। আলিবর্দী খাঁ সবে বাংলার সিংহাসন দখল করেছেন। আফগান দমন সেরে ওড়িশা থেকে ফিরছেন, মারাঠা বর্গী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর উপর। ৪০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনী। নেতৃত্বে ভোঁশলে রাজার দেওয়ান ভাস্কর রাও। যিনি ‘ভাস্কর পণ্ডিত’ নামেই বিশেষ পরিচিত।
বর্গীরা বাংলায় আসত পঞ্চকোট পাহাড় অতিক্রম করে। মেদিনীপুর জেলার উপর আক্রমণ হোত সব চেয়ে তীব্র। ১৭৪৪ সালে নাজেহাল আলিবর্দী খাঁ ছলনা করে ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করেন। নবাবের এই দুষ্কৃতির চরম মূল্য দিতে হয়েছিল মেদিনীপুরবাসীকেই। অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য, স্বয়ং রঘুজী ভোঁশলে বিশাল বাহিনী নিয়ে মেদিনীপুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সে নিষ্ঠুর অত্যাচার তুলনাহীন।
এর পর, ইংরেজ শাসনেও, প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল লাগাতার বর্গী আক্রমণ হয়েছে নিম্ন বাংলায়। অবশেষে বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলির পরিকল্পনায়, আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য—একযোগে উভয় এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে বর্গী দমন সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু বর্গী আক্রমণের ৫০ বছরে মেদিনীপুর জেলার সমাজ জীবন প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছিল। বহু সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
গ্রামীণ হস্তশিল্প আর রেশম শিল্পের সুবাদে জেলার পূর্ব এলাকার দাস পুর চিরকালই অর্থসমৃদ্ধ। ছোট-বড় বহু জমিদার পরিবারের বসবাস ছিল সেই এলাকায়। আক্রমণের অভিঘাত তাঁদের উপরেই নেমেছিল সবচেয়ে বেশি।
চেতুয়া পরগণার চেঁচুয়া গ্রামের দে পদবীর জমিদারবংশে দুর্গা, শীতলা এবং দ্বারবাসিনী নামে তিন দেবী অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্গী আক্রমণের সময়ে, দে বংশের তিন ভাই, তিন দেবীকে মাথায় নিয়ে, বাস্তুভিটে ছেড়ে, দেশান্তরী হয়ে গিয়েছিলেন।
বংশের বড়ভাই ছিলেন জনৈক বাবুরাম দে। তিনি দুর্গাকে নিয়ে সাহাপুর পরগণায় চলে আসেন। এই পরগণার বুক চিরে গিয়েছে প্রাচীন জগ্ননাথ সড়ক। তারই লাগোয়া চক নরসিংহ গ্রামে পৌঁছে, নতুন বসতি গড়েছিলেন বাবুরাম।
এখানেই নিজের জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে, বসতবাড়ির সামনেই দেবী দুর্গা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবুরাম। দেবীর নাম করেছিলেন—দশভূজা ঠাকুরানি। নতুন জমিদারবংশের কুলদেবী হিসাবে বরণ করা হয়েছিল দুর্গাকে।
দুর্গার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও পূজা প্রচলনের সময় স্থায়ী মন্দির ছিল না। পরবর্তী কালে ইং ১৮৩০ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা লিপির বয়ানটি এরকম—“শুভমস্তু সকাব্দা ১২৩৭ সালের ২০ চৈত্র সাঙ্গ”। অর্থাৎ মাত্র বছর আটেক বাকি আছে, মন্দিরের আয়ু ২০০ বছর পূর্ণ হতে।
দালান রীতির ইটের মন্দির। দক্ষিণ্মুখী হিসাবে নির্মিত। সামনের আয়তাকার অলিন্দে দক্ষিনে তিনটি খিলান-রীতির দ্বারপথ। পূর্ব ও পশ্চিমেও দুটি দ্বার আছে। গর্ভগৃহটি এক-দ্বারী। অলিন্দ এবং গর্ভগৃহ—উভয়েরই সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। কার্ণিশগুলি সরলরৈখিক।
ছাদের চারদিকের আলসের উপর চারটি করে ছোট স্তম্ভ। মাথায় আমলক এবং নিশান-দণ্ড।
টেরাকোটার কোন কাজ নাই মন্দিরে। তবে, পঙ্খের নকাশি কাজ করা হয়েছে তিনটি দ্বারপথের মাথার উপরের প্রস্থ তিনটিতে। দ্বারপাল, দ্বারপালিকা, সিংহমূর্তি– বা-রিলিফ রীতির এইসব স্টাকোর কিছু নিদর্শনও আছে মন্দিরে।
দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠার পর, সামনের প্রাঙ্গণে দুটি শিব মন্দিরও স্থাপিত হয়েছে জমিদারদের দুই শরিকের তরফে।
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী তুহিন কুমার দে, আনন্দ কুমার দে, অশোক কুমার দে, শঙ্কর চন্দ্র দে, অহিন কুমার দে, পুলক কুমার দে—চক নরসিংহ। শ্রীমতী কমলা সেন—বিধান নগর, মেদিনীপুর শহর।
পথ-নির্দেশঃ ৬ নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের ধামতোড়। এবার দক্ষিণমুখে সামান্য লালমাটির পথ মাড়িয়ে চক নরসিংহ গ্রাম এবং দে বংশের মন্দির।
Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ১৫৯।। চিন্ময় দাশ
- Advertisement -