Tuesday, May 21, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৭৮ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
কৃষ্ণরায়জীউ মন্দির, সুন্দরনগর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ—দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর সময়। সেই সময়কালে তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার প্রায় সম্পূর্ণ এলাকা ওড়িশার রাজাদের অধীনে ছিল।
ক্ষত্রিয় জাতিভূক্ত জনৈক গঙ্গানারায়ণ সিং ছিলেন পাঞ্জাবের সিরহন্দ এলাকার অধিবাসী। তাঁর জীবন কথা বহু বৈচিত্রে এবং বহুতর অভিমতে ভরা। আমরা এখানে অতি সংক্ষেপে একটি-দুটি কথার উল্লেখ করছি। ১. ইং ১৫৭০ সাল নাগাদ, জীবিকার সন্ধানে পাঞ্জাব থেকে পাড়ি দিয়ে, পুরী পৌঁছে গিয়েছিলেন গঙ্গানারায়ণ। দেবরাজ তখন উৎকল প্রদেশে পুরীর রাজা। গঙ্গানারায়ণ দেবরাজ-এর সৈন্যবিভাগে, একটি শাখার অধ্যক্ষ হিসাবে, উচ্চপদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পাঠান শাসক সুলেমান কররানির দুর্ধর্ষ সেনাপতি কালাপাহাড় পুরী আক্রমণ করলে, দৃঢ় হাতে তা মোকাবিলা করেছিলেন গঙ্গানারায়ণ।
২. পুরীর রাজা দেবরাজ গঙ্গানারায়ণের একমাত্র কন্যা রাজলক্ষ্মী দেবীকে বিবাহ করেছিলেন।
৩. ১৫৭৩ সালে রাজা দেবরাজ তাঁর শ্বশুর ও সেনাপতি গঙ্গানারায়ণকে ‘রায়’ উপাধি এবং মেদিনীপুর জেলার কাশীজোড়া পরগ্ণার ‘জায়গীর’ প্রদান করে, জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কাশীজোড়ায় গঙ্গানারায়ণ রায়-এর শাসনকাল ১৫৭৩ থেকে ১৫৮৬ সাল। অপুত্রক গঙ্গানারায়ণের পর, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র পুরুষোত্তম নারায়ণ বা যামিনীভানু রায় (১৫৮৬ থেকে ১৬২৪) রাজা হন।
এর পর ক্রমান্বয়ে রাজা হয়েছেন—৩. প্রতাপনারায়ণ (১৬২৪ – ১৬৬০) > ৪. হরিনারায়ণ (১৬৬০ – ৬৯) > ৫. লক্ষ্মীনারায়ণ-১ম (১৬৬৯ – ১৬৯২) > ৬. দর্পনারায়ণ (১৬৯২ – ১৭২০) > ৭. জিতনারায়ণ (১৭২০ – ১৭৪৪) > ৮. নরনারায়ণ (১৭৪৪ – ১৭৫৬) > ৯. রাজনারায়ণ (১৭৫৬ – ১৭৭০) > ১০. সুন্দরনারায়ণ (১৭৭০ – ১৮০৬) > ১১. বস্তিনারায়ণ > ১২. লক্ষ্মীনারায়ণ- ২য় > ১৩. রুদ্রনারায়ণ > ১৪. বিনয়নারায়ণ > ১৫. মণীন্দ্রনারায়ণ এবং ১৬. নগেন্দ্রনারায়ণ।
গঙ্গানারায়ণের প্রপৌত্রস্থানীয় এবং রায়বংশের ৪র্থ জমিদার, হরিনারায়ণ রায় যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেটা সতের দশকের শেষ পর্ব। সেসময় সারা বাংলা তথা মেদিনীপুর জেলা জুড়ে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করছে। তাতে প্রভাবিত হয়েছিলেন হরিনারায়ণও। নিজের প্রাসাদেই ‘কৃষ্ণরায়জীউ’ নাম দিয়ে, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারাণীর যুগল মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও পূজার প্রচলন করেছিলেন তিনি।
এর ঠিক একশ’ বছর পরে, এই পরগণারই পূর্ব গোপালপুর গ্রামে রাধামাধব অধিকারী নামে এক সাধক পুরুষের উদ্ভব হয়েছিল। রাধামাধব ‘শ্রীপাট গোপীবল্লভপুর’-এর মোহান্ত মহারাজ শ্রীল রাধানন্দ দেবগোস্বামীর কাছে দীক্ষালাভ এবং ‘অধিকারী’ পদবী গ্রহণ করেন। সেসময় এই কাশীজোড়া রাজবংশের ১০ম রাজা, সুন্দর নারায়ণ রায় স্বয়ং, রাধামাধব অধিকারীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
একটি প্রতিষ্ঠালিপির বয়ান অনুসারে, ১৮৪৬ সালে রাজা সুন্দর নারায়ণের পৌত্র, পূর্বোক্ত রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ (২য়) রায় কুলদেবতা কৃষ্ণরায় জীউর জন্য দালান রীতির এই মন্দিরটি গড়ে দিয়েছিলেন।
মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধারাণী ছারাও গোপাল, এক মূর্তি শালগ্রাম পূজিত হন। এছাড়াও নৃসিংহদেব নামের একটি প্রাচীন পাথরের মূর্তিও এখানে পূজিত হচ্ছেন।
নৃসিংহদেবের মূর্তিটি দণ্ডায়মান, আভঙ্গ রীতির। চতুর্ভূজ মূর্তি। ওপরের দুটি হাতে দুটি আয়ুধ। বাম হাতে শঙ্খ, আর ডান হাতে চক্র। নীচের হাত দুটিতে, কোলের উপর ধরা হিরণ্যকশিপু দৈত্যের বক্ষ বিদীর্ণ করছেন।
মূর্তিটি অক্ষত। পরিমাপ—উচ্চতা আড়াই ফুট, প্রস্থ সওয়া এক ফুট। মূর্তিটি বেশ প্রাচীন।
নিত্য পূজা ছাড়াও, দেবতার সম্বৎসরের বিশেষ পূজ়াগুলি বেশ আড়ম্বরের সাথেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কৃষ্ণরায়জীউর দালান মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়ায়, পরিত্যক্ত হয়েছে। দেববিগ্রহগুলি বসতবাড়ির ভিতর একটি কক্ষে অধিষ্ঠিত আছেন। তবে দেবতার সেবাপূজায় কোনও ঘাটতি ঘটেনি।
পরিত্যক্ত মন্দিরটি দালান রীতির। বেশ বড় মাপের। সওয়া ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২১ ফুট প্রস্থের রাজকীয় আয়তন। মেদিনীপুর জেলার এই পূর্ব অংশে, তমলুক কিংবা কাঁথি মহকুমা এলাকা পলিমাটি সম্পন্ন। সব রকম পাথরই এখানে দুর্লভ। সেকারণে, অন্যান্য প্রায় সমস্ত মন্দিরের মতোই, এই মন্দিরটিও নির্মিত হয়েছে পোড়ানো ইট আর চুন-সুরকির মর্টার দিয়ে।
বেশ উঁচু পাদপীঠের ওপর পশ্চিমমুখী সৌধ। একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে। সামনে একটি অলিন্দ, পিছনে গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের দু’দিকে দুটি পৃথক কক্ষ নির্মিত আছে। অলিন্দে তিনটি দ্বারপথ। চৌকা রীতির দুটি পূর্ণ-স্তম্ভ এবং দুটি অর্ধ-স্তম্ভের সাহায্যে দ্বারগুলি রচিত। সবগুলি দ্বারপথের খিলান ‘হাঁসগলা’ রীতির।
অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। পিছনের তিনটি কক্ষেও খিলান-রীতির সিলিং। মন্দিরের মাথায় উপরের ছাদ সমতল। চারদিকের কার্ণিশগুলি সরলরৈখিক।
মন্দিরের সামনের দেওয়ালে একটি প্রতিষ্ঠালিপি ছিল। সেটির বয়ান—“শ্রীশ্রীকৃষ্ণরায় জিউ / সকাব্দা ১৭৬৮ / সন ১২৫৩ সাল / তারিখ ২৫ আসিন”। (বানান অপরিবর্তিত) অঙ্কের হিসাবে ইং ১৮৪৬ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ পৌনে দু’শ বছর আয়ু হয়েছে সৌধটির। লিপিটি বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত। শূন্যস্থানটি অতীতের সাক্ষী হিসাবে প্রকট হয়ে আছে।
টেরাকোটা ফলক নাই মন্দিরে। অলঙ্করণের যা কিছু কাজ হয়েছিল পঙ্খের সাহায্যে। অলিন্দের দ্বারগুলির মাথায়, সমমাপের তিনটি বড় প্রস্থে, জ্যামিতিক ও ফুলকারী নকশা রচনা করা হয়েছে। নকশায় রঙের ব্যবহার করা হয়েছে সৌন্দর্যায়ণের জন্য।
রঙের বৈচিত্রময় ব্যবহার দেখা যায় তিনটি দ্বারপথের খিলানের ভাঁজগুলিতেও। কিন্তু প্রতিদিন তিলে তিলে মাধুর্য হারিয়ে যাচ্ছে সেসকল কাজের।
জানা যায়, পরবর্তীকালে, বাংলা ১৩৭৬ সনের ৫ই ফাল্গুন মন্দিরটির সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। মন্দিরের জীর্ণতা প্রকট হয়ে উঠলে, দেবতার বিগ্রহ জমিদারদের বসতবাটিতে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। সেখানে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি নিত্য পূজিত হচ্ছেন। মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। অনাদরে অবহেলায় সম্পূর্ণ বিলয়ের প্রহর গুণে চলেছে।
এই রাজবংশের নির্মিত একটি রাসমঞ্চ ছিল। সেকালে রাসমঞ্চ নির্মাণে বহুপ্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি রীতি অনুসরণ করা হত। ‘বেহারী রসুন’ নামের বিশেষ একটি গড়নে চুড়াগুলি নির্মিত হোত। উঁচু পাদপীঠের উপর স্থাপিত এই রাসমঞ্চটি নয় চুড়া বিশিষ্ট। এটিও সুদীর্ঘ্যকাল পরিত্যক্ত। ভয়ানক জীর্ণ। ঘন ঝোপঝাড়ে সম্পূর্ণ ঢাকা। ক্যামের লেন্সের সাধ্যে কুলোয়নি সে আবরণ ভেদ করবার।
আজ রাজত্ব নাই। রাজগৌরবও এখন কেবল ইতিহাসের তথ্যমাত্র। রাজকীর্তিগুলিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে একে একে। বুক মোচড়ানো দীর্ঘশ্বাস মোচন করা ছাড়া, মন্দিরগুলিকে বাঁচাবার কোন বিকল্পই নাই আজ আর।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রীমতী প্রতিমা রায়, শ্রীমতী জয়শ্রী রায়। শ্রী আদিত্য নারায়ণ রায়, শ্রী প্রীতম নারায়ণ রায়—সুন্দর নগর। শ্রী রবীন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, পুরোহিত।
পথ নির্দেশঃ পাঁশকুড়া স্টেশন-তমলুক পথের উপর জোড়াপুকুর স্টপেজ। সেখান থেকে কিমি দুয়েক দূরে সুন্দরনগর রায়বাড়ি এবং মন্দির।

- Advertisement -
Latest news
Related news