জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
সিংহবংশের ঠাকুরবাড়ি,
গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুরগড়বেতা নগরীতে একটি ঠাকুরবাড়ি আছে, সওয়া দু’শ বছর আয়ুর। ঠাকুরবাড়িটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বেশ হৃদয়গ্রাহী। বহুকালের প্রাচীন নগরী গড়বেতা। পূর্বকালের বগড়ি রাজ্যের অধীন। ‘মহাভারত’ গ্রন্থে বকদ্বীপ-এর উল্লেখ আছে। যেখানে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম বকাসুরকে নিধন করেছিলেন। সেই বকদ্বীপ কালে কালে বগড়ি নামে পরিচিত হয়েছে। বকদ্বীপ > বকডিহি > বগড়িডি > বগড়ি। বগড়ি এলাকায় আজও কতকগুলি গ্রাম আছে যেগুলি, অজ্ঞাতবাসের কালপর্বে, এই এলাকায় পঞ্চপাণ্ডবের অবস্থানের কাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বগড়িডি, একারিয়া বা ভিকনগর ইত্যাদি হোল তেমনই কয়েকটি গ্রামনাম।
যাইহোক, গড়বেতা প্রসঙ্গে প্রাচীন কালের কথা বাদ দিই। মান্য ইতিহাসের তথ্য হোল, এক সময় জনৈক গজপতি সিংহ এখানে তাঁর রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তাঁর রাজধানি এবং ‘রায়কোটা’ নামের চার দেউড়ির যে দুর্গটি গড়া হয়েছিল, তার ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায়।
গড়বেতার পূর্বকালের নাম ছিল—বেতা। ইং ১৭৭৯ সালে, ইংরেজ ভূবৈজ্ঞানিক মেজর জেমস রেণেল (১৭৪২ – ১৮৩০)-এর আঁকা মানচিত্রে বেতা নামের উল্লেখ আছে।
গজপতির বংশের পর, বিষ্ণুপুর মল্ল রাজবংশের পত্তন হয়েছিল এখানে। মল্লবংশের রাজা দুর্জন সিংহ একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দির গড়েছিলেন গড়বেতারই বামুনপাড়ায়। সেটি এখনও অবস্থিত আছে।
এইসকল রাজাদের সময়কালে, উত্তর ভারত থেকে বেশ কয়েকজন ভাগ্যাণ্বেষী পুরুষ গড়বেতায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। অগস্তি, শুকুল, তেওয়ারী প্রভৃতি তাঁদের উদাহরণ। তাঁদের কেউ কেউ জমিদারীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখানে।এই আগমনের ধারায় ছিল সিংহ পদবীর একটি পরিবারও। সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয় এই পরিবারটি এসেছিল উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলা থেকে। রানি অহল্যাবাই রোড নামের প্রাচীন একটি পথ গড়বেতার উপর দিয়ে প্রসারিত আছে। মেদিনীপুর জেলা হোল, উত্তর ও মধ্য ভারত থেকে, কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্য এলাকার প্রবেশদ্বার। দূর-দূরান্তরের বণিকের দল, তীর্থ পরিক্রমারত সাধু-সন্ন্যাসীর দল এই পথেই যাতায়াত করতেন।সিংহ পরিবারটিও এই পথে জগন্নাথ ধাম পুরী গিয়েছিলেন তীর্থদর্শনের জন্য। ফিরতি পথে, গড়বেতাতে থেকে গিয়েছিল পরিবারটি। কালে কালে একটি জমিদারীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা।
সিংহবংশের গুরুদেব একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন—‘দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ’-এর মন্দির দেখা হয়নি তাঁর। সেসময় এই বংশের জমিদার ছিলেন হোকরু সিংহ। প্রবীন গুরুদেবের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের নামে বারোটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সেই সাথে বিষ্ণু আরাধনার জন্য, একটি বিষ্ণুমন্দিরও গড়া হয়েছিল। সেটি ছিল ইং ১৯৯৪ সালের ঘটনা। তখন থেকে মন্দিরস্থলীটি “ঠাকুরবাড়ি” নামে পরিচিত হয়ে আছে।
ঠাকুরবাড়ির আয়ু যখন ২০০ বছর পার হয়েছে, বেশ জীর্ণ হয়ে পড়েছিল মন্দিরগুলি। ভাঙাচোরা মন্দিরগুলির ভবিষ্যত কল্পনা করে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন দু’জন মানুষ। তাঁরা ছিলেন জমিদার স্বর্গত রামচন্দ্র সিংহের দুই পুত্র-কন্যা—শ্রী অমর নাথ সিংহ এবং শ্রীমতী মনোরমা সিংহ। সেসময় রামচন্দ্রের দৌহিত্র, মনোরমা দেবীর সুযোগ্য পুত্র, শ্রীযুত বি. কে. সিংহ মহাশয়, নিজে সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করে, ঠাকুরবাড়ির পূর্ণ সংস্কার করে দিয়েছিলেন।
ঠাকুরবাড়ির প্রাচীর ঘেরা প্রাঙ্গণের ভিতরে দুই দেবতার মন্দিরগুলি। মহাদেব শিব এবং ভগবান বিষ্ণু— গুণে গুণে তেরোটি মন্দির দুই দেবতার। এক. দ্বাদশ শিবালয় ঃ ১২টি শিবমন্দিরই গড়া হয়েছে ওড়িশী শিখর-দেউল রীতি অনুসরণ করে। তবে, কেবলমাত্র বিমানসৌধটিই নির্মিত হয়েছে। সামনে জগমোহন, নাটমন্দির বা ভোগমণ্ডপ নির্মিত হয়নি।
মন্দিরগুলি দুটি সারিতে সাজানো। পূর্বদিকে পাঁচটি পশ্চিমমুখী সৌধ। পশ্চিমের সাতটি সৌধ পূর্বমুখী। মন্দিরগুলি ইটের তৈরি। ফুট দুয়েক উঁচু পাদপীঠ। মন্দিরকে ঘিরে প্রদক্ষিণ-পথ আছে প্রত্যেকটিতেই।
প্রতিটিতেই খিলান-রীতির একটি করে দ্বারপথ। গর্ভগৃহগুলির ভিতরের ছাদ বা সিলিং হয়েছে চারদিকে চাপা-খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে। গর্ভগৃহে কোন গৌরীপট্ট নাই। একটি করে অগভীর গম্ভীরার ভিতর লিঙ্গবিগ্রহগুলি স্থাপিত।
বর্তমানে যে বিগ্রহগুলি দেখা যায়, সেগুলি আদি বিগ্রহ নয়। মন্দির প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পরের ঘটনা। সেসময় জমিদার ছিলেন শ্রীযুত দুর্গা প্রসাদ সিংহ। তিনি গরুর গাড়ীর কাফেলা সাজিয়ে, সুদূর বারানসী থেকে ১২টি শিবশিলা এনেছিলেন। জাগযজ্ঞ করে অভিষেক হয়েছিল নব-প্রতিষ্ঠিত শিলাগুলির।
যাইহোক, মন্দিরের শীর্ষক বা চুড়াগুলি ভারি সুদর্শন। বেঁকি, আমলক, কলস এবং ত্রিশূলদণ্ড—সবই বেশ সুরচিত।
শিবের মন্দিরগুলিতে তেমন কোন অলঙ্করণ নাই। ভাঙ প্রস্তুতকারক সাধু, দ্বারবর্তিনী ইত্যাদি দু’-একটি ফলক দেখা যায়। সবগুলিই পঙ্খের কাজ।
২। লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির ঃ এই মন্দিরটি হোল ঠাকুরবাড়ির মুখপাত। অর্থাৎ ঠাকুরবাড়ির মূল ফটকের পরেই এই মন্দিরটি স্থাপিত।
বেশ উঁচু পাদপীঠ। মন্দিরকে ঘিরে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ। পূর্বমুখী ইটের মন্দির। ভূমি-নকশা ২০ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বর্গাকার। নির্মিত হয়েছে এক-রত্ন মন্দির হিসাবে।
সামনে একটি অলিন্দ। তাতে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। স্তম্ভগুলি গড়া হয়েছিল ইমারতি-রীতিতে। আদিতে সেগুলির গড়ন ছিল ডম্বরুর আকারের। উপর-নীচ দুই অংশ স্ফীত, মধ্যভাগ ক্রমশ ক্ষীণ। কিন্তু বছর পঁচিশ পূর্বে, বিগত সংস্কার কাজের সময়, স্তম্ভগুলির গড়ন বদল হয়ে গিয়েছে।
গর্ভগৃহে দেবতার অধিষ্ঠান-বেদীটি চোখে পড়বার মতো। সুন্দর একটি তোরণের আকৃতি, তাতে পঙ্খের রঙীন নকশা করা। গর্ভগৃহের ভিতরের ছাঁদ বা সিলিং হয়েছে, দুই স্তর খিলানের মাথায়, গম্বুজ স্থাপন করে। অলিন্দে টানা-খিলানের সিলিং।
এক-রত্ন মন্দির। রত্নটির বাঢ়-অংশটি চতুষ্কোণ। প্রত্যেক দেওয়ালে কলিঙ্গধারায় পঞ্চ-রথ বিভজন করা। কিন্তু রত্নটির গণ্ডী অংশ আট-কোণা (অক্টাগোনাল) গড়নের। এমন অভিনব দৃষ্টান্ত ব্যতিক্রমী নয়। তবে কিছুটা বিরল।
টেরাকোটা ফলকের স্বল্প কিছু অলঙ্করণ আছে মন্দিরে। কার্ণিশের নীচে এক সারি, দুই কোণাচ অংশ বরাবর দুটি সারিতে ফলকগুলি সাজানো। মোটিফ হিসাবে চতুর্মুখ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, নন্দীবাহন মহেশ্বর, ময়ুরবাহন কার্তিকেয়, ছিন্নমস্তা কালী, দ্বি-ভূজা সিং হবাহিনী দুর্গা, উদবাহু গৌরাঙ্গ, বুদ্ধদেব, দেবরাজ ইন্দ্র ইত্যাদি মূর্তি রচন করা হয়েছে।
একটি গরুড়মূর্তি আছে প্রথম কার্ণিশের উপর, সেটি পঙ্খের কাজ।
এই ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার মূল ফটকটি বেশ রাজকীয়।
ঘটা করে রাস উৎসব হয় দেবতার। মন্দিরের অদূরেই একটি রাসমঞ্চও আছে। তবে, গড়ন একটু ভিন্ন রীতির। অষ্ট-দ্বারী আট-কোণা মঞ্চ। কিন্তু চুড়া মাত্র একটিই। সেটিও আট-কোণা, অষ্ট-দ্বারী। চারটি দ্বার উন্মুক্ত, অবশিষ্ট চারটি প্রতিকৃতি-দ্বার। সেগুলির প্রতিটিতে একটি করে মূর্তিবিন্যাস করা হয়েছে।
সাক্ষাতকারঃ শ্রী গৌতম সিংহ—সিংপাড়া পাকা বাখুল।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর-বাঁকুড়া পথের উপর গড়বেতা চটি। পথের পশ্চিমেই ঠাকুরবাড়িটি অবস্থিত। এছাড়া, খড়গপুর – আদ্রা রেলপথের গড়বেতা স্টেশন থেকেও এখানে পৌঁছানো যাবে।