Wednesday, May 22, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১৮১ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
চিন্ময় দাশদ্বাদশনাথ শিব মন্দির,
শিলদা (বিনপুর।ঝাড়গ্রাম) মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমের এলাকাগুলি পূর্বকালের ‘জঙ্গলখণ্ড’-এর অন্তর্ভুক্ত। সেই এলাকার একেবারে পশ্চিমে বিখ্যাত রাজবংশটি ছিল শিলদায়।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘দশ-সালা’ বন্দোবস্ত চালু করলে, প্রত্যেক জেলার কালেক্টর সেই জেলার জমিদারদের কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ১৭৮৭ সালে শিলদার রাজা মানগোবিন্দ মল্লরায় যে বিবরণ দাখিল করেছিলেন, তা থেকে জানা যায়, জনৈক মেদিনী মল্ল এই রাজবংশটির পত্তন করেছিলেন।
মেদিনী মল্ল তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্থানীয় এক রাজা বিজয় সিংহকে উৎখাত করে। বিবরণ থেকে জানা যায়—মেদিনী মল্ল ৪১ বছর, মঙ্গলরাজ মল্ল ৫৭ বছর, গৌরহরি মল্ল ৬৭ বছর নির্বিবাদে রাজত্ব করেছেন।
গৌরহরির পুত্র মানগোবিন্দ মল্ল মারা যান ১৮০৬ সালে, বিবরণ দাখিলের ২০ বছর পর। সাতজন রানি ছিল মানগোবিন্দের, কিন্তু পুত্রসন্তান ছিল না। শাসনক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন, সাত রানির অন্যতম, রানি কিশোরমণি দেবী। ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর রাজত্ব করেছেন তিনি।
প্রজাকল্যাণে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন এই রানি। শত্রু এবং বিদ্রোহী দমনও করেছেন শক্ত হাতে। সেসকল কারণে, কোন কোনও ঐতিহাসিক ‘রাজা কিশোরমণি’ নামে উল্লেখ করেছেন এই রানিকে।
কেবল দক্ষ প্রশাসকই ছিলেন না, কিশোরমণি ছিলেন ধর্মপ্রাণাও। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে প্রভাবিত হয়েছিলেন। দুটি বিষ্ণুমন্দির স্থাপন করেছিলেন রাজবাড়ির অঙ্গণের ভিতরেই—কিশোরকিশোরী মন্দির এবং রাধাকৃষ্ণ মন্দির। কিন্তু শৈব আরাধনার ধারাটিকে অমান্য করেননি। মেদিনী মল্ল আসবার বহু পূর্বকাল থেকে মহাদেব শিবের আরাধনা প্রচলিত ছিল শিলদায়। এই নগরীর অদূরে ওড়গোন্দায় একটি বিস্তৃর্ণ প্রান্তরে দুটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। সেগুলির একটি শিবের মন্দির ছিল বলে পুরাবিদগণেরও অভিমত। ‘ভৈরব স্থান‘ নামেই প্রান্তরটির পরিচয়। সম্বৎসর মহা আড়ম্বরে উৎসব হয় সেখানে।
নিজে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা করলেও, জঙ্গলখণ্ডের আবহমান কালের এই শৈবধারাকে উপেক্ষা করেননি রানি। নিজের ৪২ বছরের শাসনকালে, ১২টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। শিলদা নগরীতে চারটি এবং বাকি আটটি মন্দির গড়েছিলেন জমিদারী মহালের বিভিন্ন এলাকায়—হাড়দা, জাড়দা, শুকজোড়া, রূপাই, ভাগা বাঁধ, রাজপাড়া এবং শিমূলপাল মৌজায়। (একটি মন্দিরের সন্ধান আমরা পাইনি।) শিলদা নগরীর চারটি মন্দির হোল—আবালগঞ্জনাথ, শম্ভুনাথ উমেশ্বরনাথ এবং বর্তমান আলোচ্য দ্বাদশনাথ মন্দির।
এই মন্দিরের বিগ্রহের নাম দ্বাদশনাথ শিব। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রানি কিশোরমণি দেবী নিজের হাতে দ্বাদশ শিবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমান মন্দিরের বিগ্রহের নামকরণ করেছিলেন ভারতবর্ষের ‘দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ’-এর স্মরণে।
মন্দিরের পুরোহিতের অভিমত, এই মন্দিরের গর্ভগৃহেই দ্বাদশ মহাদেব বিরাজিত আছেন। সেকারণেই এমন নাম। প্রকৃতপক্ষে, গর্ভগৃহে গম্ভীরার ভিতর মূল শিবলিঙ্গটি ছাড়া, পূর্বদিকের দেওয়ালে এগারোটি পাথরখণ্ড রাখা আছে। সেগুলিও শিবের প্রতীক হিসাবে নিত্যদিন পূজিত হয়। তা থেকেই ‘দ্বাদশনাথ’ নাম।
গম্ভীরায় স্থাপিত মূল শিবলিঙ্গটি স্থানীয় কোনও পাথরে নির্মিত হয়েছিল। বিগত পৌনে দু’শ বছরে, ক্ষয়রোগ এবং ফাটল প্রকট হয়েছে শিবলিঙ্গটিতে।
মন্দিরটি চালা-রীতির। কেবল মেদিনীপুর জেলাই নয়, সারা বাংলায় চালা-রীতির মন্দিরের সংখ্যা অগণন। চালা-মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট হোল সহজ কারিগরী আর সরল সৌন্দর্য। কেবল এ কারণেই, একেবারে উদ্ভাবনের সময় থেকেই, বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছিল এই রীতির মন্দিরগুলি।
চালা-মন্দিরের অনেকগুলি গড়ন। এক-চালা, দো-চালা, চার-চালা, আট-চালা এবং বারো-চালা। তবে, চার-চালা এবং আট-চালা মন্দিরই সংখ্যায় বেশি। সেই তুলনায়, অন্য মন্দিরগুলি প্রায় দেখাই যায় না।
আরও বিশ্লেষণ করে দেখলে, বলতে হয়, চালা-মন্দিরের মধ্যে আট-চালাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেয তুলনায় চার-চালা মন্দিরের সংখ্যা অনেকই কম।
দ্বাদশনাথ শিবের পশ্চিমমুখী এই মন্দিরটি চার-চালা শৈলীতে নির্মিত হয়েছে। একটি সঙ্কীর্ণ প্রদক্ষিণ-পথ মাকড়া পাথরে (ল্যাটেরাইট) তৈরি মন্দিরটিকে বেষ্টন করে আছে। কোনও অলিন্দ নাই। খিলান-রীতির এক-দ্বারী গর্ভগৃহে গম্ভীরার ভিতর শিবলিঙ্গটি স্থাপিত। গর্ভগৃহের ভিতরের ছাদ বা সিলিং হয়েছে চার দেওয়ালের মাথায় চারটি অর্ধ-খিলান স্থাপন করে।
মন্দিরে কোনও অলঙ্করণ নাই। সামনে যে নাটমন্দির, সেটি পরবরতী কালের সংযোজন।
সাক্ষাৎকারঃ সর্বশ্রী মধুসূদন মজুমদার, শচীনন্দন গাঙ্গুলী—শিলদা।
পথ-নির্দেশঃ বাস /ট্রেন যোগে ঝাড়গ্রাম এসে, বেলপাহাড়ীর পথে শিলদা। বাঁকুড়া থেকে রাইপুর হয়ে, কিংবা পুরুলিয়া থেকে ঝিলিমিলি, বেলপাহাড়ী হয়েও শিলদা পৌঁছানো যাবে।

- Advertisement -
Latest news
Related news