জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
শ্যামলেশ্বর শিব মন্দির (দাঁতন, পশ্চিম মেদিনীপুর) প্রাচীন মন্দির মাত্রেই কিংবদন্তির আঁতুড়ঘর। যে মন্দির যত প্রাচীন, তত বেশি কিংবদন্তির সমাবেশ তার মুকুটে। এই মন্দির তার একটি উদাহরণ। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণতম প্রান্তের প্রাচীন নগরী দাঁতন। অনেকের মতে, দাঁতনের পূর্বনাম—দন্তপুর। বিখ্যাত বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দাঠাবংশ’-এ উল্লেখ আছে, বুদ্ধদেবের ‘ক্ষেম’ নামক এক শিষ্য বুদ্ধদেবের একটি দন্ত সং গ্রহ করেছিলেন। কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্ত একটি মন্দির নির্মাণ করে, দন্তটি প্রতিষ্ঠা করেন। তা থেকেই এই নগরীর নাম হয়—দন্তপুর।
বহু প্রাচীন মূর্তি, পোড়ামাটির ভাঙা আসবাবপত্র, শিলালিপি, পানপাত্র, বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধমস্তক, মহাবীর মূর্তি ইত্যাদি দাঁতন থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব দাঁতনের প্রাচীনত্বের প্রমাণ।
অতি সম্প্রতি, দাঁতন থেকে সামান্য তফাতে, মোগলমারীতে উৎখননে আবিষ্কৃত হয়েছে ‘মহাবন্দক বৌদ্ধ মহাবিহার’ নামে আস্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার।
মধ্যভারত থেকে জগন্নাথধাম পুরী পর্যন্ত প্রসারিত যে প্রাচীন জগন্নাথ সড়ক (ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড), তার উপরেই দাঁতনের অবস্থান। ভারত সম্রাট এবং বাংলার নবাবদের সেনাবাহিনী বহুবার দাক্ষিণাত্য অভিযান করেছে এই পথ ধরেই। এই প্রাচীন ঐতিহাসিক পথের গায়েই শ্যামলেশ্বর শিবের একটি প্রাচীন মন্দির অবস্থিত।
কেউ বলেন উজ্জ্বয়িনী রাজ্যের অধিপতি বিক্রমাদিত্য-এর শ্বশুর ভোজ রাজার শাসনাধীন ছিল দন্তপুর। ভোজরাজাই মন্দিরটি গড়েছিলেন।
কেউ বা বলেন, মন্দিরটি গড়েছিলেন দণ্ডভুক্তির রাজা বিক্রমকেশরী। তাঁর রাজধানি ‘অমরাবতী’র অবস্থান ছিল দাঁতন নগরীর সামান্য উত্তরে। বিক্রমকেশরীর কন্যা শশীসেনা এবং মন্ত্রীপুত্র অহিমাণিক্যের প্রেমকাহিনী নিয়ে ‘শশীসেনার পাঠশালা’ নামের কাব্য রচনা করেছিলেন বর্ধমানের লোককবি ফকিররাম। সেদিনের অমরাবতীর উপরেই বর্তমানের মোগলমারির অবস্থান। উৎখনন থেকে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি উঠে এসেছে সেখানেই।
বহু অতীতকাল থেকে পণ্ডা পদবীর স্থানীয় একটি ব্রাহ্মণবংশ শ্যামলেশ্বর মন্দিরে পৌরহিত্য করেন। বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন পূজা নিয়ে। সারা দিনমান পূজা চলতে থাকে দেবতার।
এই মন্দিরের ‘চৈতি গাজন’-এর বিশাল খ্যাতি। চৈত্রের ১৫ তারিখ থেকে সংক্রান্তিদিন পর্যন্ত বিস্তার গাজনের। ১৩ ভোগের গাজন। অধিবাস এবং মহামেল নিয়ে ১৫ দিন চলে উৎসবটি।
ভক্তা বা মূল সন্ন্যাসির সংখ্যাও ১৩। ৯টি মৌজার ৯ জন, স্থানীয় ভূস্বামীর ২ জন, বাড়ুয়াবংশের ১ জন এবং মন্দিরের নিয়ুক্ত ১ জন। এই নিয়ে ১৩ জন ভক্তা—পাটভক্তা বা প্রধান ভক্তা, দেউলপড়িশা, কামিনাপাত্র, ভোগপাত্র, ভাণ্ডারঘরিয়া, আলমস্বামী, ছত্রস্বামী, দণ্ডস্বামী, পোড়াস্বামী, মেলস্বামী, পুষ্পপাত্র, মাণিকপাত্র এবং কোটালপাত্র—এমনই সব নাম ভক্তাদের।
এবার মন্দিরের গঠনরীতিটি দেখে নেওয়া যাক। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত– দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর সময়কাল ধরে, আজকের মেদিনীপুর জেলার প্রায় সমগ্র ভূভাগ কলিঙ্গ রাজাদের শাসনাধীন ছিল। এবং দাঁতন নগরীটি বর্তমান ওড়িশার সীমানালগ্ন। সেকারণে, ওড়িশী শিল্প-সংস্কৃতির গভীর প্রভাব এই এলাকায়। বিশেষত মন্দির স্থাপত্যে সেই প্রভাব বেশ গভীর।
যাইহোক, প্রতিষ্ঠালিপির না থাকায়, মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা কে করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায় না। জানা যায় না প্রতিষ্ঠার সময়কালও। তবে, পূর্ববর্তী পুরাবিদ্গণ অনুমান করেছেন, কেশিয়াড়ি থানায় পীঢ়-রীতির সর্বমঙ্গলা মন্দির সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নির্মিত হয়েছিল। একই রীতিতে নির্মিত এই মন্দিরটিও, সেসময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকতে পারে।
অন্যদের অভিমত, ওড়িশার সূর্যবংশীয় নৃপতি গজপতি মুকুন্দদেব (শাসনকাল ১৫৫৯ – ১৫৬৮) ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
দাক্ষিণাত্য এলাকার দুর্গ-মন্দির (ফোর্ট টেম্পল)-এর আদলে, মাকড়া পাথরের ফুট দশেক উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মন্দির। ভেতরের অঙ্গণটির আয়তন ১৩,৮৮৩ বর্গফুট। তার ভিতর ফুট চারেক উঁচু ভিত্তির উপর মন্দিরটি স্থাপিত।
ওড়িশী পীঢ়-রীতির মন্দির। মাকড়া পাথরের পূর্বমুখী সৌধ। সামনে জগমোহন, মাঝে অন্তরাল এবং পিছনে বিমান বা গর্ভগৃহ—তিনটি অংশ এই সৌধের। দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট, প্রস্থ সাড়ে ১১ ফুট এবং উচ্চতা মোটামুটি ২০ ফুট। ভক্তদের পরিক্রমার জন্য একটি প্রদক্ষিণ পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে।
গর্ভগৃহটি বর্গাকার। বাঢ় এবং গণ্ডী জুড়ে পঞ্চ-রথ বিভাজন। সারা জেলায় পঞ্চ-রথ পীঢ়শৈলীর সুন্দর নিদর্শন এই মন্দির। মাথায় চার-চালা রীতির ছাউনি। তাতে পাঁচটি পীঢ় বা থাক ভাগ করা। ওপরে বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, ত্রিশূল স্থাপিত।
জগমোহনটি পূর্ব-পশ্চিমে আয়তাকার। সেটিতে দক্ষিণে একটি অতিরিক্ত দ্বারপথ আছে। মাথায় অর্ধগোলাকার চালা ছাউনি। কিন্তু ভিতরের সিলিং লহরা পদ্ধতির। পরবর্তীকালে একটি নাট্মন্দির যুক্ত হয়েছে জগমোহনের সামনে।
মন্দিরের অলঙ্করণ হিসাবে দেখা যায়—১. মূল প্রবেশপথের সামনে একটি নন্দীমূর্তি (কালাপাহাড়ের আঘাতের চিহ্ন সহ)। ২. মন্দিরের উত্তরদিকে, নেতনালার মুখে, পাথরে খোদিত একটি মকরমূর্তি। হুগলি জেলার মহানাদ গ্রামেও এমনই কারুকাজ করা প্রাচীন মকরমুখ পাওয়া গিয়েছে। এগুলি গুপ্তযুগের নিদর্শন। ৩. সামনের দ্বারপথের মাথায় ভগবান বিষ্ণুর অনন্তশয্যা ফলক।
৪. জগমোহন সৌধে, কলিঙ্গ-স্থাপত্য রীতিতে, কয়েকটি মিথুন ফলক ছিল। পরিতাপের কথা, সংস্কার কাজের সময় সেগুলি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
এগুলি ছাড়াও, পাথরের একটি ‘কাল্ভৈরবী চক্র’ রক্ষিত আছে এই মন্দিরে।
সাক্ষাৎকারঃশ্রী চণ্ডীচরণ পণ্ডা, পুরোহিত—দাঁতন।
সহযোগিতাঃ সর্বশ্রী সূর্য নন্দী, বিশ্বজিত ঘোষ, তরুণ সিংহ মহাপাত্র—দাঁতন।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর বা খড়্গপুর থেকে দক্ষিণে বালেশ্বরমুখী রাস্তার উপর দাঁতন। শহরের মন্দিরবাজারে ভবানীপুর মৌজায় মন্দিরটি অবস্থিত।