Wednesday, May 22, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৭৭ ।।  চিন্ময় দাশ                              

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ                                                ভূবনেশ্বরী মন্দির, আযোধ্যা                                         (চন্দ্রকোণা শহর, পশ্চিম মেদিনীপুর )
এবারের নিবন্ধ দেবী ভূবনেশ্বরী নামে শ্রীশ্রীদুর্গার একটি মন্দির নিয়ে। দেবী এখানে স্বয়ং আবির্ভূতা। লোকশ্রুতির আকারে, একটি চমকপ্রদ কাহিনী আছে তাঁর আবির্ভাব সম্পর্কে। প্রথমে সেটি শুনে নেওয়া যাক।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

হুগলি জেলায় আরামবাগ মহকুমার নকুণ্ডা গ্রাম। দত্ত পদবীর একটি বনেদি কায়স্থ বংশের বাস ছিল সেখানে। সেই বংশের ধর্মপ্রাণ এক সদস্যের (সেবাইত পরিবার থেকেও তাঁর নামটি জানা যায়নি।) নিত্য নদীস্নানের অভ্যাস ছিল। একদিন স্নানের ঘাটে নেমেছেন দত্তমশাই। সবে প্রথম ডুবটি দিয়ে উঠেছেন। দেখতে পেলেন, সামনে দিয়ে একটি “ডোল” ভেসে যাচ্ছে নদীর জলে। ডোলটিতে ছিল দেবী দুর্গা আর ভূবনেশ্বর শিবের দুটি বিগ্রহ। এবং কিছু দলিল-দস্তাবেজ।
ভক্তিভরে ডোলটি তুলে, ঘরে নিয়ে এসেছিলেন দত্তমশাই। সেদিন রাতেই তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। সেইমতো, দলিলে লিখিত সম্পত্তিতে পৌঁছে, নিজের ভদ্রাসন গড়েছিলেন। মন্দির গড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুই দেবদেবীকে।
শ’আড়াই বছর আগের কথা এটি। দলিলে উল্লেখ ছিল, চন্দ্রকোণা নগরীর সম্পত্তির কথা। সেসময় চন্দ্রকোণা বর্ধমান রাজবংশের শাসনে এসেছে। ইং ১৭০২ সালে চন্দ্রকোণা পুণরুদ্ধার করে, সেখানে রাজা কীর্তিচন্দ্র নতুন একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘অযোধ্যা’ নামে। অনেকগুলি দেবালয় সহ, বিশাল পরিসরের একটি ‘ঠাকুরবাড়ি’ গড়ে তুলেছেন সেখানে।
দেবী স্বয়ং তাঁকে সেবাপূজার সুযোগ করে দিয়েছেন– আপ্লুত হয়ে, নকুণ্ডার জন্মভিটে ছেড়ে, চিরকালের জন্য চন্দ্রকোণা চলে এসেছিলেন দত্তমশাই। সাথে নিয়েছিলেন দুটি দেববিগ্রহ আর সম্পত্তির নথিপত্র। অযোধ্যা পল্লীতে নতুন গড়ে ওঠা বর্ধমানরাজের ঠাকুরবাড়িটিই তাঁর পছন্দ হয়েছিল পবিত্রভূমি হিসাবে। সেই ঠাকুরবাড়ির পাশেই নিজের নতুন ভদ্রাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। একটি মন্দির গড়ে স্থাপন করেছিলেন ভূবনেশ্বরী নামের দুর্গা এবং ভূবনেশ্বর নামের মহাদেব শিবকে।
পরে, সেই মন্দিরের পাশেই, আরও দুটি মন্দির গড়েছিল দত্তবংশ। তাতে রামেশ্বর এবং কামেশ্বর নামের আরও দুই শিব প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এছাড়া,গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে, কালে কালে লক্ষ্মীজনার্দন নামের একটি বিষ্ণুশিলারও স্থান হয়েছে মন্দিরে।
এসবের ফলে, শৈব, শাক্ত এবং বৈষ্ণব—তিন ধারাতেই পূজার্চনা হয় এখানে। শৈবমতে শিব চতুর্দশী; শাক্তমতে দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, কালী, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর পূজা হয় ঘটা করে। আর বিষ্ণুর জন্য ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’-এর আয়োজন তো আছেই। জন্মাষ্টমী, তালনবমী এবং রাস উৎসব তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পৃথক একটি রাসমঞ্চও আছে দত্তদের এই মন্দিরস্থলীতে।
তবে, ভূবনেশ্বরী এবং মহাদেবের সাথে বিষ্ণুও আছেন একই গর্ভগৃহে, একই বেদীতে। বিষ্ণু থাকার কারণে, দুর্গাপূজায় বলিদান করা যায় না। বলিদানের জন্য, নবমী তিথিতে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গার বিগ্রহকে।
সঙ্কট আছে আরও একটি। বিষ্ণুর অবস্থানের কারণেই, অন্নভোগ নিবেদন করা যায় না দেবীকে। সেকারণে, বছরে একদিন দেবীর বিগ্রহকে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরামিষ অন্নভোগ দাখিল করা হয় সেখানে। এজন্য মকর সংক্রান্তির পরের দিনটিকে নির্দিষ্ট করা আছে।
চন্দ্রকোণা নগরীতে দেবী ভূবনেশ্বরীর প্রভাবমণ্ডলের বিস্তার বহুদূর। বহু পরিবার আসেন তাঁদের মানতের পূজা নিয়ে। সেসময় কেউ অলঙ্কার, কেউ বা বস্ত্র নিবেদন করে যান দেবীকে। দেবীর জন্য নিবেদিত শাড়িটি কিন্তু ১১ হাত হতেই হয়।
দেবীর আদি বিগ্রহটি বহুকাল পূর্বে চুরি হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে অষ্টধাতুর একটি মূর্তি স্থাপিত আছে এখানে। আশ্চর্যের বিষয় হোল, পুরোহিত মশাই দেবীর সেই অনুচ্চ মূর্তিটিকে, বিশেষ দক্ষতার সাথে, ১১ হাত দৈর্ঘ্যের শাড়িটি সুন্দরভাবে পরিয়ে দেন।
এক সময় মন্দির নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিল সেকালের ‘মানা’ বা পরবর্তীকালের ‘চন্দ্রকোণা’ নগরী। একবার ভয়ঙ্কর যুদ্ধে, রাজা কীর্তিচন্দ্রের কামানের গোলায়, অধিকাংশ মন্দির ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য যুদ্ধশেষে, অনেকগুলি মন্দির নতুন করে গড়ে দিয়েছিলেন কীর্তিচন্দ্র। পরবর্তীকালে তাঁর পৌত্র তেজচন্দ্র কিছু মন্দিরের সংস্কার করিয়েছিলেন।
কিন্তু আজ প্রায় সওয়া তিনশ’ বছর বাদে, সেসকল মন্দিরের কোনও মন্দির সম্পূর্ণ অব্লুপ্ত। কোনওটি বা জীর্ণ, বিগ্রহ নাই শূণ্য গর্ভগৃহে। কোথাও হয়ত সেবাপূজাটি কোনও রকমে প্রচলিত আছে দেবতার।
এসবের ভীড়ে, চন্দ্রকোণা নগরীর একান্তে, একেবারে প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই, পূর্ণ মহিমা নিয়ে বিরাজিত আছেন দেবী ভূবনেশ্বরী। তাঁর প্রভাবমণ্ডল ক্ষুণ্ণ হয়নি আজও। আজও ভক্তদের জমায়েত হয় তাঁর মন্দিরটিতে।
ফুট তিনেক উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর, মাকড়া পাথরে গড়া, দালান-রীতির পূর্বমুখী মন্দির। বর্গাকারই বলা যায় সৌধটিকে। কেন না, এটির দৈর্ঘ্য পৌনে ১৭ ফুট, প্রস্থ সওয়া ১৬ ফুট। বেদীর উপর থেকে মন্দিরের উচ্চতা ১২ ফুট।
সামনে খিলান-রীতির তিনটি দরজা সহ একটি অলিন্দ। থামগুলি চারটি করে গোলাকার স্তম্ভের গুচ্ছ। গর্ভগৃহটি খিলানের এক-দ্বারী। মাথায় সমতল ছাদ। কার্ণিশটি সেকারণে সরলরৈখিক। তাতে কিছু মূর্তি সন্নিবেশ করা হয়েছে।
উন্মুক্ত নাট্মন্দিরটি বেশ প্রশস্ত। তার দশটি দ্বারপথ সৃষ্টি হয়েছে করিন্থিয়াম শৈলীর স্তম্ভের সাহায্যে। মাথায় কড়ি-বরগার সিলিং দেওয়া।
এই নাট্মন্দিরের গা-লাগোয়া উত্তর দিকে পর পর দুটি শিব মন্দির। তবে, আকারে ছোট। এ দুটি মন্দির আট-চালা রীতির। দুটিতে দুই মহাদেব বিরাজিত আছেন।
নাটমন্দিরের সামনে একটি সপ্তরত্ন রাসমঞ্চ নির্মিত আছে। এটির ভিত্তিবেদীও ফুট তিনেক উঁচু। সাত-চুড়ার এই মঞ্চের, সাতটি স্তম্ভের গায়ে, নারীমূর্তি রচিত হয়েছে। ঠাকুরবাড়িটি বেশ সযত্ন রক্ষিত।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রীমতি আল্পনা দত্ত। সর্বশ্রী স্বপন কুমার দত্ত, মানস দত্ত, সমীর দত্ত, চণ্ডীচরণ চক্রবর্তী (পুরোহিত)— অযোধ্যা। শ্রী কল্যাণ সরকার—হাওড়া।
পথ-নির্দেশঃ মেদিনীপুর শহর, পাঁশকুড়া স্টেশন, চন্দ্রকোণা রোড স্টেশন কিংবা আরামবাগ থেকে চন্দ্রকোণা আসা যায়। সেখানে নতুন বাসস্ট্যাণ্ড থেকে টোটো নিয়ে, অযোধ্যা রঘুনাথ ঠাকুরবাড়ির কাছেই মন্দিরটি অবস্থিত।

- Advertisement -
Latest news
Related news