Tuesday, May 21, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ১৭৬ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশশ্রীধর মন্দির, পলাশপাই
(দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর) চিরপ্রবাহিনী কংসাবতী। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া হয়ে, এ নদীর শেষ বিচরণভূমি মেদিনীপুর জেলা। বাঁকুড়া থেকে বিণপুর থানায় পৌঁছে, জেলার একেবারে বুক চিরে বয়ে গিয়েছে নদীটি। পরে, দুটি শাখায় বয়ে গিয়েছে নদীটি। মূল শাখাটি দক্ষিণে, অন্যটি গিয়েছে পূর্বে। পূর্বমুখী শাখাটি বিলীন হয়েছে রূপনারায়ণ নদে পৌঁছে।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

সেই সঙ্গমের সামান্য পশ্চিমে পলাশপাই গ্রাম। নদীর একেবারে কোলেই। চেতুয়া পরগণায় এ নদীর দুই তীরে অগণন দেবালয়। বড় একটি নব-রত্ন মন্দির গড়ে উঠেছিল পলাশপাই গ্রামেও। কিন্তু ঘটনাচক্রে, ভেঙে দিতে হয়েছিল মন্দিরটিকে। নিজের হাতেই মন্দিরটিকে ভেঙে ফেলতে হয়েছিল সেবাইত বংশকে। ভারি করুণ, ভারি মর্মন্তুদ সেই ঘটনা।
আজ দু’শ বছর পরেও শোনা যায় সেদিনের কাহিনী। তখন ইংরেজের শাসনকাল। এক ইংরেজ সাহেব জুতো পরা অবস্থায় উঠে পড়েছিলেন দেবতার মন্দিরে। সেই অনাচারের অভিঘাতে, নিজের হাতে বিশাল আর অলঙ্কৃত দেবালয়টিকে ভেঙে দিয়েছিলেন মন্দিরের সেবাইত।
কিন্তু দেবতার জন্য তো নতুন একটি আলয় চাই। তাঁর অধিষ্ঠানের জন্য, দালান রীতির একটি মন্দির গড়ে নিতে হয়েছিল সেসময়। সেই মন্দিরের কথকতা আজকের এই জার্ণালে।
ভেঙে ফেলা মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। কেউ বলেন, ধর্মপ্রাণ এক সাধুপুরুষের জন্ম হয়েছিল এখানের ‘দাস ঠাকুর’ পদবীর একটি পরিবারে। তিনি একদিন ‘যখের ধন’ পেয়েছিলেন দেবতার দান হিসাবে। সেই অর্থে তিনি জমিদারী আর কুলদেবতার জন্য মন্দির গড়েছিলেন।
তবে, ইতিহাস আর সেবাইত বংশ থেকে জানা যায় অন্য কথা। মেদিনীপুর জেলা ওড়িশা রাজ্যের সীমান্ত লাগোয়া। এক সময়, দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর ওড়িশার রাজাদের অধীনে ছিল মেদিনীপুর জেলা।
ওড়িশার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব (ইং ১৫৫৯ – ১৫৬৮) একবার গৌড় আক্রমণ করে, একেবারে ত্রিবেনী পর্যন্ত অধিকার করে নিয়েছিলেন। সেসময় মেদিনীপুর জেলার প্রায় সম্পূর্ণ এলাকা তাঁর অধীনে চলে গিয়েছিল। মুকুন্দদেব এক বিশবাসঘাতকের হাতে নিহত হয়েছিলেন। সেসময়েই সুলেমান কররানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের ওড়িশা অভিযান।
সেই রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটের সময়ে, প্রাণ ও স্বধর্ম রক্ষার জন্য, বহু ব্রাহ্মণ পরিবার ওড়িশা থেকে বাংলায় চলে এসেছিলেন। সেটাই সূচনা। পরে পরে দীর্ঘকাল যাবত বহু নিষ্ঠবান ব্রাহ্মণ পরিবার বাংলায় চলে আসেন। মেদিনীপুর জেলা ওড়িশার সীমান্তলগ্ন হওয়ার কারণে, তাঁদের সিংহভাগ এসে পৌঁছেছিলেন মেদিনীপুর জেলাতেই।
পলাশপাই গ্রামের এই মন্দিরের সেবাইত ‘দাস ঠাকুর’ বংশও ওড়িশা থেকেই এসেছিলেন। পূর্বকালে চন্দ্রকোণা, বরদা, চেতুয়া ইত্যাদি পরগণাগুলি সরকার মান্দারণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরামের পৌত্র কীর্তিচন্দ্র এগুলি অধিকার করে নিয়েছিলেন। সেসময় চন্দ্রকোণা নগরীতে একটি কাছারি স্থাপন করেছিলেন কীর্তিচন্দ্র।
দাস ঠাকুর বংশের জনৈক ব্যক্তি ছিলেন বর্ধমানরাজের এক গোমস্তা। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায়, তিনি নিজেও একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজের অট্টালিকার সাথে, কুলদেবতার জন্য একটি মন্দিরও গড়েছিলেন তিনি।
তখন ইংরেজ শাসনকাল। এলাকার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে কংসাবতির শাখা নদীটি। সরকারী রাজপুরুষরা ছাড়াও, এই পথে তখন রেশম আর নীল ব্যবসায়ী বিদেশী সাহেবদের নিত্য আনাগোনা।
একবার এক ইংরেজ সাহেব, পায়ের জুতো না খুলেই, বিশালাকার সুদৃশ্য নব-রত্ন মন্দিরটিতে উঠে পড়েছিলেন। অন্য কোন বিহিত ছিল না তখন আর। নিজের হাতে সেই মন্দির ভেঙে দিয়েছিলেন সেবাইত পরিবার।
নব-রত্ন রীতিতে, বড়সড় আকারে নির্মিত ছিল আদি মন্দিরটি। সেটি ভেঙে দেওয়ার পর, মাঝারি মাপে দালান-রীতির এইমন্দিরটি গড়ে নেওয়া হয়েছিল।
দক্ষিণমুখী মন্দিরটি ইটের তৈরি। পাদপীঠ বেশ উঁচু। সামনে একটি তিন-দুয়ারী অলিন্দ। তাতে দরুণ-রীতির খিলানের তিনটি দ্বারপথ। পিছনের এক-দ্বারী গর্ভগৃহটি বেশ প্রশস্ত।
দেবতার অধিষ্ঠান-বেদীটি একটি বিশিষ্ট রীতির। সেটি ডম্বরু-র আদলে নির্মিত হয়েছে। অলিন্দ এবং গর্ভগৃহ – দুয়েরই সিলিং হয়েছে খিলানের সাহায্যে।
মন্দিরে তেমন কোন অলঙ্করণের কাজ নাই। কেবল স্টাকো-র দু’-একটি ‘বা-রিলিফ’ রীতির কাজ মাত্র।
মন্দির থেকে সামান্য দূরে, নব-রত্ন রীতির একটি রাসমঞ্চ আছে দেবতার। রত্ন বা চুড়াগুলি বেহারিরসুন-রীতির। আটটি দ্বারপথ। সেগুলির দু’পাশের স্তম্ভের প্রতিটিতে, উপর-নীচে দুটি করে, বা-রিলিফ রীতির টেরাকোটা মূর্তি স্থাপিত। মোটিফ মূলতঃ বংশীবাদনরত শ্রীকৃষ্ণ, লম্বোদর গণেশ, ময়ূরবাহন কার্তিক, বাদ্যযন্ত্র সহ বাদিকামূর্তি ইত্যাদি।
মন্দিরের সামান্য তফাতে একটি পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র আছে এই বংশের। পূর্বপুরুষদের কয়েকটি জীর্ণ সমাধি দেখা যায় সেখানে।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী অর্জুন দাস ঠাকুর এবং শ্রী গণেশ দাস ঠাকুর—পলাশপাই।
পথ-নির্দেশঃ দ. পূ. রেলপথের পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে ঘাটালমুখী রাস্তায় গৌরা। এবার পলাশপাই খালের পাড় ধরে ৫/৬ কিমি দূরে সিনেমা মোড়। সেখানে খালের দক্ষিণ পারে পলাশপাই গ্রাম ও মন্দির।

- Advertisement -
Latest news
Related news