Tuesday, May 21, 2024

কুম্ভ কথা ( পর্ব – ১ )

- Advertisement -spot_imgspot_img

(দ্য খড়গপুর পোষ্ট ভ্রমন বিষয়ক লেখা শুরু করতে চেয়েছিল আরও আগেই। প্রতি বুধবার ‘বুধে পা’ শীর্ষক এই লেখা পেতে কিছুটা সমস্যা হয়। এরপর সাহিত্যিক বিনোদ মণ্ডল আকাশ থেকে প্রায় চাঁদ পেড়ে আনলেন । সেই চাঁদের নাম শুভঙ্কর দত্ত ।
শুভঙ্কর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি শাহি স্নান সারার পাশাপাশি আগে পরে কুম্ভ যাত্রা নিয়ে কয়েক কিস্তি নামিয়ে ফেলেছেন। কুম্ভ নিয়ে বাঘা বাঙালি কম কিছু লেখেনি। বাংলার প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের কম বেশি অনেকেই দিস্তা দিস্তা কুম্ভ নামিয়েছেন । সেখানে দর্শন আর দার্শনিকের প্রাবল্য । তাঁদের মাথায় রেখেই শুভঙ্করের কাজ নিয়ে পড়লাম। আর নির্দ্বিধায় বলছি শুভঙ্করের কুম্ভ কথা আপাদ মস্তক ভ্রমন কাহিনী। যে বাঙালি কেবলমাত্র নির্ভেজাল ভ্রমনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের তাবৎ জনপদ চষে ফেলতে চান শুভঙ্করের কুম্ভকথা তাঁদের জন্য গাইডবুক। শুধুই কপালে চোখ তুলে হাঁটা যায়না , পায়ের তলার মাটিটাও জানা জরুরি । কুম্ভের সেই মাটি চিনিয়েছেন শুভঙ্কর দত্ত ।  কেন সেটা জানার জন্য কুম্ভকথা পড়তেই হবে।
শুভঙ্করের লেখা হাতে পাওয়ার পর কিছু কাজ সারার ছিল আর সেটা সারতে সারতেই চলে এল লোকসভা নির্বাচন। বাঙালি রাজনৈতিক ব্যঞ্জনে বাদ বাকি সব কিছুকেই তেতো বলেই গণ্য করে এটা ধরে নিয়ে বহু লেখা পড়ে থাকল কিছুদিন , এমনকি ‘কুম্ভ কথা’ও ।
অবশেষে সেই লেখা প্রকাশের কাজ শুরু হল। আজ প্রথমদিন  ২টি কিস্তি প্রকাশ পাচ্ছে এরপর প্রতি বুধবার । আশাকরি পাঠকের ভাল লাগবে ।আর কুম্ভ নিয়ে লেখা প্রকাশ পাচ্ছে খবর পেয়েই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের প্রচ্ছদটি আঁকলেন রামকৃষ্ণ দাস । বিনোদ শুভঙ্কর আর রামকৃষ্ণর জন্য দ্য খড়গপুর পোষ্ট কৃতজ্ঞ ।আর হ্যাঁ , ভ্রমন বিষয়ক লেখায় আপনিও স্বাগত ।  )

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

   

কুম্ভ কথা- ১


কুম্ভে একা ঠিক জমে না। অমৃতা কে কত করে বললাম,  দুজনে চলো যাই । উত্তর এলো, দুর ছাই । অগত্যা একাই । ২২ তারিখ কাটা,  ৭৮ আরএসি কনফার্ম । মনটাও বিস্কফার্ম । বেশ মুচমুচে । ট্রেনে উঠে গুছিয়ে বসা গেল । এদিক ওদিক কাঁচা পাকা গোঁফ দাড়ি গাঁজাখোর লাল কৌপিন, কালো লুঙ্গী, সফেদ বস্ত্র ধারী দের ঢুলুনি আর আমার সামনের সারিতে দুই বোরখা ছ ফুটি শোহর  এর সঙ্গে মশকরা  দেখতে দেখতে খানিক সময় কাটল ।

কনিষ্ঠার তুলনায় জ্যেষ্ঠা টি অধিক চপলা, আকর্ষণীয়াও বটে । ওদিকে উৎকল বাসী রামানন্দী নন্দীভৃঙ্গী গণ আমাকে নিতান্তই অর্বাচীন বিবেচনায় কুম্ভ মাহাত্ম্য- ইলাহাবাদ-হরিদ্বার-উজ্জয়ন-নাসিক-শিপ্রা-গোদাবরী বুঝিয়ে চলেছে আর এদিকে মীর বাসিত আলি তার ফরজানা ও রুকসানা মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে….আমার  ম্যায় ক্যায়া বলুঁ,আপলোগ বুজুর্গ হ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি শুনে ।

তারপর কথায় কথা বাড়ল।  এপাশ ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল আরো উৎসুক মুখ । মীর সাহেব ও চলেছেন বডো় র বাপের বাড়ী ইলাহাবাদের বহরানা মহল্লায়, ছোটোকে সঙ্গে নিয়ে ।  বোরখা আবৃত বড়ো র চোখে এক আকাশ আলো…..আমরা ও কতবার গেছি প্রয়াগরাজে, কিল্লায়, চবুতরায় কবুতর কে কত খাইয়েছি অউর মছলি কো ভি  । অন্যদের ছানাবড়া চালসে পড়া চোখে তখন অন্য ভারতবর্ষ । মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল- মীর সাহাব জয় কুম্ভ বোল কে তিন ডুবকি লাগা লেনা , আপকি ঘর কি চিরাগ জলদিহি আপকা ঘর রোশন করেগা । মুরাদ পুরি হোগি । ছোটো অচানক বলে উঠল, আপকো ক্যায়সে মালুম ! ওপরের বার্থ থেকে রামানন্দী নিত্যগোপাল বাবাজী বলে উঠলেন, এহি কুম্ভ হ্যায়….

কুম্ভ কথা- ২


ঘন কুয়াশা ঘেরা সাতটা পঁয়তাল্লিশের সকাল ।  নৈনৈ তে দাঁড়িয়ে ট্রেনটা বেশ অনেকক্ষণ । মীর সাহেব খানিক্ষণ ইতস্তত করে এসে বসলেন পাশে ।  জিজ্ঞেস করলেন , ভাইসাব, হম নাহা সকতে হ্যায় না প্রয়াগ মে….দুচোখে তার সংশয় ।

নানা কথা বলে সংশয় দুর করার চেষ্টা করা গেল, পারলাম কিনা সন্দেহ রয়েই গেল। ইলাহাবাদে একনম্বর প্লাটফর্মের বাইরে পিপুল গাছের পাশে অভয় শ্রীবাস্তব ।  অটো তে স্টার্ট দিয়ে বলল, দাদা, দারাগঞ্জ হোকে নহি যায়েঙ্গে, ভীড় বহোত হ্যায় ।

১৪ নম্বর সেক্টরে আস্তানায় ঢুকেই গরম চা য়ে আপ্যায়িত করলেন আসামের দুই সন্নাসিনী মাতা । একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন এবারে একাই….ভাই রা আসেনি । ১৩ র পর ১৯, মুখ টা মনে ছিল এঁদের!! বিস্ময় কাটল না, কাটবে না কোনোদিন…..কিঁউকি এহি কুম্ভ হ্যায় |

তাড়াতাড়ি বেরোব ।   হর্ষবর্ধন মার্গ হয়ে সোজা জিটি রোড, কালি মার্গ, মোরি মার্গ, রেলব্রীজ শাস্ত্রী পুল পার হয়ে ১নং পুল হয়ে সঙ্গম ।  ঝুঁসি র দিকে সাধুজনেরা ।  মহামন্ডলেশ্বর গন ।  নাগা সাধু দের ডেরা ।  খুঁজে নিতে হবে চেনা জন দের ।  ভাব জমাতে হবে অচেনাদের সঙ্গে । রান্নার দেরী ছিল একটু । পাশাপাশি ঘুরে দেখে নেওয়া গেল যোগী আদিত্যনাথের এলাহি ব্যবস্থাপনা ।

শাকভাজা, শুক্তো, ডাল, পাতগোবি র তরকারী, দইবড়া, চাটনির অভাবনীয় ভুরিভোজের পর শরীর এলিয়ে গেল|পাশের শিবির থেকে ডান কানে রামকথা, বাঁ কানে বৈদিক মন্ত্রপাঠ কে সঙ্গী করে দুটো নাগাদ ঝোলা ঝাপটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া গেল ।  আস্তানায় আমার তাঁবুতে পড়ে থাকল জনা কুড়ি ৫০ থেকে ৮৫ এর নাসিকাগর্জন। দু চোখে চাখতে চাখতে চলেছি ।  গোশালা থেকে শুরু করে দমকল, রামদেব থেকে জুনা আখাড়া ।  জৈন – শিখ-  পুরী-গিরি- বাবাজী- নন্দ- জানা অজানা শিবির গুলি । হাতছানি দিয়ে ডাকছে কেউ কেউ । যাচ্ছি কথা বলে আবার চলা ।

প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর মিশে গেলাম রামানুজ সম্প্রদায়ের সাথে ।  প্রায় হাজার তিনেক ভক্তবৃন্দ কে গিয়ে গুরু মহারাজ চলেছেন স্নানে । চললাম ওদের সাথে, বাজনা বাদ্যি সমারোহে । ঘুরে ঘুরে আরো দেড় কিলোমিটার পথ বেয়ে অবশেষে সঙ্গমে । বেলা সাড়েতিনটা নাগাদ । ভাই সাব, আপ ভি নাহা লো । সামান এহি পর ছোড় দো…হাম হ্যায় না । জয় শ্রী রাম । কষে দর বারো ডুব দেবার পর দেখি আর উঠতেই ইচ্ছে করছে না জল থেকে । নৌকার উপর থেকে সাবধান করলেন মিলিটারি ভাই, ভাইয়া বিমার পড় যাওগে । এবার ফিরব ।  অন্য রাস্তায় ।  একঝাঁক সিআরপিএফ  কয়েকজন বিদেশি কে রাস্তা বোঝাতে ব্যস্ত ।  ওরা এসেছে ডেনমার্ক থেকে । গতবারেও এসেছিল ।  এবারে বেশ খুশি আয়োজন দেখে ।  বিশেষ করে মহিলা দের পোশাক পরিবর্তনের সুন্দর ছোটোছোটো অসংখ্য  খোপ করে দেওয়া হয়েছে দেখে ।
এগিয়ে চলি ।

গঙ্গার তীরে একজন হাতছানি দেয় ।
তোরা তিন ভাই না….বিস্ময় কাটার আগেই ছেলে মেয়ে দের কথা, হিন্দি তে বলে চলে আরো অনেক কথা।  লাড্ডু দেয় খেতে ।  আমিও দিই বাদাম, কিসমিস ।
নমস্কার করে পকেটে হাত দিতে গেলে বলে ওঠেন, কুছ দেনা হ্যায় তো, এক তুলসীদাসী রামায়ন খরিদ কে দো ।  কিনে দিলাম ।  ২০০টাকা পড়ল । খুব খুশি ।  আরো দশমিনিট আটকে চার পাতা পড়ে গেয়ে শোনাল অযোধ্যার বাবা শ্রী মদন দাস । চা তেষ্টা পেয়েছে খুব ।  আখাড়াগুলো র দিকে এগোচ্ছি।  পঞ্চ দশনামী, নিরঞ্জনী, আবাহনী, উদাসীন….. ইত্যাদি ইত্যাদি।  কাউকে দেখে ভালো লাগলে গিয়ে বসি, কথা বলি ।  অনেকে ডাকেও ।  একজন ডাকল, আ যাও, থোড়ি দের বয়ঠ লো, বহোত থকে হুয়ে  লাগ রহে হো । গেলাম ।  পা চলছিল না আর । গিয়ে বসতেই একগোছা আঙুর।  লো বেটা ,সেবা করো ।  একে না বলার জো নেই ।  বছর পঁয়তিরিশের নগ্ন শরীর পরম যত্নে  নিজে বানিয়ে চা এর কাপ এগিয়ে দেয় ।  লো বেটা, পিও।
প্রনামী স্বীকার করলেন না , উল্টে আস্নানের দিন আমন্ত্রন জানালেন ডেরায়, সবেরে সবেরে। সঙ্গে করে স্নানে নিয়ে যাবেন, সেবা করবেন।  এহি কুম্ভ হ্যায়। ১৬ সেক্টরে মহাকাল সম্প্রদয়ের সাধু বাবাজী একপ্রকার জোর করেই এটা ওটা বলে কিছু টাকা নিল । চলো, এভি কুম্ভ হ্যায়।
১৫ সেক্টরে ইসকনের মিছিল।  বিদেশি, বিদেশিনী দের নাচ আর আমাদের আদিখ্যেতা ভরা হ্যাংলা চোখ। রিকি  বা বুবুল থাকলে ছবি তুলত বেশ। দোকানে বসে পকোড়া খেতে খেতে বেশ উপভোগ করা গেল।
ঘড়িতে সাড়ে আটটা । এখনো প্রায় দু কিমি পথ ফিরতে হবে ।  প্রায় ১২-১৩ কিমি হাঁটা হলো আজ।  পায়ের তলা গুলো জ্বালা করছে।  একসঙ্গে দু তিন জন থাকলে কষ্ট টা সহনীয় হয়। তাই কুম্ভ তে একা আসতে নেই। কিন্তু কি আর করা যাবে!  কুম্ভ যো হ্যায়

সমস্ত ছবি – লেখক
লেখক – শুভঙ্কর দত্ত 
- Advertisement -
Latest news
Related news