কুম্ভ কথা- ১৪

কখনো যদি সম্ভব হয় কুম্ভ যাস একবার , বাবা বলেছিল। তখন অনেক ছোট। কুম্ভ থেকে পেয়েছিলেন নর্মদেশ্বর কে। লৌকিক- অলৌকিক, বিশ্বাস – অবিশ্বাসের এর সীমানা ছাড়ানো সেসব কাহিনী লালিত হয়, জারিত হয়। কুম্ভের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। অবর্ননীয়!কিসের আকর্ষণে ,মোহমায়ায় এ তীব্র জনস্রোত। এত কষ্ট। আখাড়া গুলির গেট বন্ধ। চলমান ভারত হাতে, কাঁধে, মাথা বোঝা নিয়ে হাঁটছে, হেঁটে চলেছে। রাস্তাতেই বিশ্রাম।২৪ কিমি বিস্তৃত মেলা ক্ষেত্র থিক থিক করছে।গাড়ী বন্ধ।দু’পা ই সম্বল।আর সম্বল ভরসা।কাল সময়ের মধ্যে পৌঁছতে পারব তো যথা স্হানে।দেখা হবে তো আখাড়া গুলির শাহি স্নান।কি জানি।এবারে সময় সূচী প্রকাশ্যে আনেনি মেলা কমিটি।অত্যন্ত গোপনীয় রেখেছে আখাড়াগুলি।
সঙ্গম যাওয়ার অনেক পথ বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। পথ ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গঙ্গায়, যমুনায় অনেক স্নান ঘাট। প্রশাসনের মাথাব্যাথা এই পাঁচ -ছ কোটি লোকের নিরাপত্তা এবং তাদের নিরাপদে ঘর ফেরার ব্যবস্হা করা।
সমস্ত বিভাগ সক্রিয়, সজাগ, সাহায্যে তৎপর।
তবুও চিন্তা। চিন্তা এই বিশাল পরিমান জনগণ কে নিয়ে। এক আখড়ার সামনে বসে দেখছি এই অকল্পনীয় প্রবহমান মানব মানবী। তাঁদের পদধূলি তে ধন্য এই প্রয়াগ ক্ষেত্রে উপস্হিত আছি ,এটাই অনেক বড় ব্যাপার।
দেখা আর চোখে মেখে নেওয়া মাত্রাহীন তৃপ্ততা কথায় প্রকাশ হয় না |
কুম্ভ কথা- ১৫
হাঁটা, হাঁটা এবং হাঁটতে থাকা। দেখতে থাকা মানুষের রং রূপ। ভীড় এতো মনোরম, এত সুন্দর !রাত দুটো তে বেরিয়ে, মানুষের ঠেলায় ঠিকানাতে যখন পৌঁছানো গেল , তখন সূর্যের প্রকাশ অনুভূত হচ্ছে। ঘন কুয়াশার মাঝে আখাড়া মার্গ। পুলিসের বাঁশি ,ঘোড়পুলিসের ,কমান্ডো, এসপিজির দাপাদাপি। আমার লক্ষ্য ব্যারিকেড। কোনোভাবে যদি পৌঁছানো যায়।
এক ফুট এগোলে পনের ফুট পিছনে চলে যেতে হচ্ছে নিমেষে। ভিড়ের মাঝে অসতর্ক হলেই পদপিষ্ট হয়ে দলা পাকিয়ে যেতে হবে। আমার নিশানা ৪৩ নং পোস্ট।বাঁ পা টা তুলতেই আচমকা ধাক্কার দমকে ৫০ মিটার পিছনে। দুরে আখড়া মার্গে ভেরী র আওয়াজ….আসছে আসছে….। ব্যারিকেড থেকে তখন প্রায় ১০০মি দুরে | কতক্ষণ জানিনা, দেখলাম ঠেলায় পিছোতে পিছোতে সঙ্গম থেকে ৫০০মি দুরে চলে এসেছি। মানুষের মাথাও নজরে নেই, কেননা সামনের জনের মাথা আমার চোখের উপর। শুধু শব্দ। ওদিকে বাজনার আওয়াজ আরও ঘন হয়ে কানে বাজছে। ব্যারিকেডের বাঁশটা তৃতীয়বারের তেষ্টায় ধরতে পেরে জয় কুম্ভ চিৎকারে টেনে আনলাম নিজেকে। চিৎকারের সাথে সাথে গগন ভেদী আওয়াজ উঠল জয় কুম্ভ। বাঁশি ছুটে এল। এল ঘোড়পুলিস।
এরপর একে একে আখাড়াগুলির স্নান যাত্রা। মন্ডলেশ্বর, পীঠাধীশ্বর দের শোভাযাত্রা। ঠায় দু ঘন্টা…পায়ের অস্তিত্ত্ব টের পাচ্ছি না। পিঠের উপর চাপ। দমবন্ধ হয়ে আসছে। আধঘন্টার চেষ্টায় একটু পিছিয়ে এসে সেকটর ৪এ একটা ফাঁকা আখড়ার সামনে বালির উপর বসে পড়তেই হল।পায়ে চার পাঁচ জায়গায় ফোসকা।রক্ত ,রস, ধুলো, বালি চিটিয়ে বিচ্ছিরি অবস্হা। ঘন্টা খানেক বসে আবার উঠলাম। আরো ঘন্টাখানেক লাগল স্নান করে উঠতে।শরীরের সমস্ত ক্লান্তি দূর। এবার মানুষ ফিরছে,আসছে,হাসছে,কাঁদছে,কাঁপছে,হারাচ্ছে…..লোক আবার বাড়ছে।ভয় ও বাড়ছে।সরে আসতে হবে নিরাপদ দূরত্বে। চারিদিকে শুধু কালো মাথা। এখন ফেরা যাবেনা।ভিড় ঠেলে। স্নান যাত্রা পুরোটা না দেখতে পাওয়ার আক্ষেপ ক্লান্তি কষ্ট বাড়ছে ।কুম্ভে একা এজন্যই আসতে নেই |
সঙ্গী একজন লাগে।পরস্পরের চোখে কুম্ভ সচল থাকে।
তবুও এটাই পরম পাওয়া। অনির্বানের আসার কথা।পৌঁছতে পারল কিনা, কে জানে।কমপক্ষে১০-১৫ কিমি হাঁটা ছাড়া উপায় নেই ওদের। ফোন ত্রিস্তরীয় জামাকাপড়ের ভিতর । বের করতে ইচ্ছে নেই এখন। চা দরকার।