Wednesday, May 22, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১৮।। পংকজ কুমার মল্লিক।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

সংগীত- রত্নাকর
পংকজ কুমার মল্লিক বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

মানুষটির জীবিকা ছিল পাটের বাজারে দালালি বা ‘জুট ব্রোকারি’। সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় (১৯২৭) অবিরাম বর্ষণে অনেকের সাথে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক অবাঙালি ডাক্তারবাবুর চেম্বারের সামনে, এক ফালি বারান্দায়। কলকাতার বর্ষাভেজা রূপসী সন্ধ্যায় গুনগুনিয়ে গাইছিলেন– ‘এমন দিনে তারে বলা যায়. .. .। ‘পেছন থেকে টোকা দিয়ে চেম্বারে ডেকে নেন মুগ্ধ শ্রোতা -ডাক্তার রামস্বামী আয়েঙ্গার। আলাপ করেন। সেই সুবাদে পৌঁছে যান – বেতার অফিসে। পাটের দালালির পাট চুকিয়ে বেতার কেন্দ্রে যুক্ত হন।তারপর বাংলা গানের ইতিহাসে ঘটে যায় নিঃশব্দ বিপ্লব। মানুষটির নাম পংকজ কুমার মল্লিক (জন্ম ১০ মে ১৯০৫ — মৃত্যু ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮)।
তখনও রবিবাবুর গান রবীন্দ্র সংগীত হয়ে ওঠেনি। দরদ দিয়ে ,মীড় দিয়ে ,রসের অলৌকিক মাধুর্য ছড়িয়ে গান গাইবার মতো যোগ্য লোক হাতে গোনা কয়েকজন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র দীপেন্দ্রনাথের পুত্র দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (দিনু ), সাহানা দেবী ,দিলীপ কুমার রায় প্রমুখ এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য । নিজের গানের বিকৃতি নিয়ে খুঁতখুঁতে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন। এমনই যুগসন্ধিক্ষণে পংকজ কুমার মল্লিকের প্রফুল্ল প্রকাশ।

উত্তর কোলকাতায় মানিকতলার পাশে ভাড়া বাড়িতে বড় হয়েছেন। বাবা -মণিমোহন , মা -মনোমোহিনী। বাল্য শিক্ষা সিটি ইনস্টিটিউশন মাইনর স্কুলে। ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশুনা বেশি দূর চালানো যায়নি। গানের স্রোতে ভেসে গেলেন। বৈষ্ণব পরিবারটিতে ধারাবাহিক গানের চর্চা তেমন ছিলনা। সংগীতজ্ঞ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নাড়া বাঁধেন। টপ্পা কীর্তনসহ নানা ধরণের গান শিখতে শিখতে আকৃষ্ট হন রবি ঠাকুরের গানে। উপলব্ধি করেন ভাব- ভাষা-সুরের ত্রিবেণী সংগমে স্নাত হতে না পারলে জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। জোড়াসাঁকো অভিযান এবং রথীন্দ্রনাথের সাথে নাটকীয় সাক্ষাৎ, রবিবাবুর সান্নিধ্যলাভ -নানা নাটকীয় ঘটনার ঘাট পেরিয়ে দিনু ঠাকুরের সাহচর্য্য লাভ করেন। ‘হেরি অহরহ তোমারি বিরহ ভুবনে ভুবনে রাজে হে’ গানটির শিক্ষাসূত্রে দীনেন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্র গানে দীক্ষা নেন পংকজ কুমার ।

১৯২৬ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রথম গানের রেকর্ড ‘নেমেছে আজ প্রথম বাদল’ শ্রোতাদের দরবারে উপস্থাপিত করেন পংকজ কুমার মল্লিক। প্রকাশ করে ভিয়েলোফোন কোম্পানি।১০২৭সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বেতারে প্রথম পরিবেশিত হয় দুটি গান ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ এবং ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারি এ তরুমূলে’। তারপর থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ র বিকাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত কাজ করেছেন তিনি। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন বাবু এবং স্টেশান ডিরেক্টর স্টেপলন সাহেবের সস্নেহ প্রশ্রয়ে বেতারে শুরু করেন সংগীত শিক্ষার আসর (১৯২৯)। দ্বিজেন্দ্রলাল ,রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, নজরুল প্রমুখ গীতিকবিদের গানের পাশাপাশি কাব্যগীতি শেখানোর কাজে আত্ম নিয়োগ করেন।

মানুষের কাছে রবীন্দ্র সংগীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে কবির অনুমতি ও পরামর্শ ক্রমে কাজ করেছেন পঙ্কজকুমার। নিজে যেমন গেয়েছেন পাশাপাশি কানন দেবী, কে. এল. সায়গল প্রমুখদের দিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাহিনীতে এবং অন্যের কাহিনীতে চিত্রায়িত ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম সার্থক প্রয়োগকর্তা ছিলেন তিনিই। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে পর্দার আড়ালে বাদ্যযন্ত্রসহ প্রয়োজনানুগ আবহ সংগীত ব্যবহার করেছেন। নিউ থিয়েটার্সের প্রথম সবাক ছবি শরৎচন্দ্রের ‘দেনা-পাওনা’তে রাইচাঁদ বড়ালের সাথে সুরকার হিসেবে হাজির হন তিনি ।

১৯৩২ সাল থেকে শুরু করে প্রায় চার দশক বাংলা , হিন্দি ,উর্দু ও তামিল ছবিতে কাজ করেছেন পঙ্কজ। কুন্দনলাল সায়গল , শচীনদেব বর্মণ , হেমন্ত মুখোপাধ্যায় , গীতা দত্ত , আশা ভোঁসলে প্রমুখ নক্ষত্র তাঁর সুরে কণ্ঠ দিয়েছেন। সে সময় যখন প্লে ব্যাকের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা, তখন যে সব অভিনেতা অভিনয়ের সঙ্গে দক্ষ কণ্ঠ শিল্পী ছিলেন , তাদের চিত্র পরিচালকগণ বেশি পছন্দ করতেন। ফলে গায়ক- নায়ক পঙ্কজ কুমারের গগনস্পর্শী জনপ্রিয়তা দেখা যায়। তাঁর অভিনীত বিখ্যাত ছায়াছবি গুলির মধ্যে মুক্তি ,ডাক্তার, নর্তকী অধিকার, কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি। সায়গল ,কানন দেবী ,প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক।

পঙ্কজ কুমারের জীবনের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল নিউ থিয়েটার্স ষ্টুডিওতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং শানওয়াজ খানের উপস্থিতি তে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’এর জন্য ‘কদম কদম বড়ায়ে যা’ও ‘শুভ সুখ যেন কি বরখা বর্ষে’ গান দুটির রেকর্ডিং ও যন্ত্রানুষঙ্গ পরিচালনা। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’ গানটিরও তিনি সুরারোপ করেন। রঙ্গমঞ্চে নাটকের গান পরিচালনাতেও আনন্দ পেতেন পঙ্কজকুমার। ১৯৬৯ সালে বিগলিত করুণা জান্হবী যমুনা ছবিতে মন্ত্র ও শ্লোক রেকর্ডিং ছিল তাঁর গায়ক জীবনের অন্তিম রেকর্ডিং।

সম্মান ও পুরস্কারে ভরে গিয়েছে হৃদয়। সারস্বত মহামণ্ডল প্রদান করেছে ‘সুরসাগর’ সম্মান (১৯২৯)। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের হাত থেকে গ্রহণ করেছেন সংগীত রত্নাকর (১৯৫৬)উপাধি। ভারত সরকার প্রদান করেছে পদ্মশ্রী (১৯৭০) এবং দাদাসাহেব ফালকে (১৯৭২) সম্মান। Tagore Research Institute প্রদত্ত ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধিকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন তিনি। তবে অসম্মানের মুখোমুখি হয়ে যন্ত্রণায় দীর্ণও হয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালে প্রায় তাঁর অগোচরে সংগীত শিক্ষার আসর থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে, খুব দুঃখ পেয়েছেন। তাঁর সর্বব্যাপ্ত পরিচিতি যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান দিয়ে, তাও একবছর বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৩২ সালে মহাষষ্ঠীর সকালে বেতার থেকে প্রথম যা সম্প্রসারিত হয়। রচনায় বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ), ধারাভাষ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। যার প্রতিবাদে কলকাতার রাস্তায় মিছিল হয়েছিল সেবার। এই ঘটনার অভিঘাতে তিনি হৃদরোগ আক্রান্ত হন। ঘটে যায় চরম বিপদ।

আজ বিশ্ব জুড়ে রবীন্দ্র সংগীতের অনন্য গ্রহণীয়তার পেছনে পঙ্কজ কুমারের আজীবন সাধনাও যে কাঠবেড়ালির ভূমিকা পালন করেছে সেদিন ,ভেবে আনন্দ হয়। মানুষটির জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে চর্চা ও গবেষণা আমাদের বঙ্গ সংস্কৃতিকে পুষ্ট করবে , এই প্রত্যাশা স্বাভাবিক।★

- Advertisement -
Latest news
Related news