প্রতিভাধর জ্যোতিষ্ক
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিনোদ মন্ডল
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহত্তম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ।বিশ্ববন্দিত তিনি। তাঁর প্রতিভা বিকাশে সবচেয়ে বেশি সহায়ক দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অবদানও অপরিসীম। শুধু রবি-বিকাশে নয়, বঙ্গ-সংস্কৃতি ও সমাজের নানা আঙ্গিকে কাজ করেছেন তিনি। রবির চেয়ে বারো বছরের বড়ো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে নাট্যকার, বলিষ্ঠ অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, পত্রিকা সম্পাদক, চিত্রশিল্পী এবং সমাজকর্মী [৪.৫.১৮৪৯ — ৪.৩.১৯২৫)।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র তিনি। মা-সারদাদেবী। বাল্যশিক্ষা দাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। পরে সেন্ট পল ও মন্টেগুজ স্কুলে। ১৮৬৪ সালে হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করেন। তখন তাঁর অন্যতম সহপাঠী ছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও লেখক রমেশ চন্দ্র দত্ত। এরপর আর্টস পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে থিয়েটারের অমোঘ আকর্ষণে বুঁদ হয়ে গেছেন তরুণ জ্যোতিরিন্দ্র। ফলে অসমাপ্ত থেকে যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
পারিবারিক জোড়াসাঁকো থিয়েটারকে সংহত করবার লক্ষ্যে এবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। উদ্যোগ নিলেন অদ্ভুতনাট্য অভিনয়ের (Extravaganza)। বিভিন্ন লেখকের রচনাংশ জুড়ে একজাতীয় নাট্যকোলাজ নির্মাণ করেছেন। গানে তাঁর প্রতিভা যথেষ্ট ছিল। ভালো পিয়ানো বাজাতেন। প্রশাসক দাদা সত্যেন্দ্রনাথের আহমেদাবাদ প্রবাসে সঙ্গী হয়ে কিছুদিন শিখেছিলেন সেতার বাদন ও অঙ্কনবিদ্যা। ফলে নাটকের উপযোগী কনসার্ট রচনায় পারদর্শী হন তিনি।
অভিনেতা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন বিপুল। “কৃষ্ণ কুমারী” নাটকে রাণী অহল্যার চরিত্রে এবং “একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে সার্জেন্টের ভূমিকায় যাত্রা শুরু। ‘নবনাটকে’ নটীর ভূমিকায় তিনি অনবদ্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন! অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, ” জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তপ্তকাঞ্চন- নিন্দিত বর্ণ এবং অনিন্দ্যকান্তি চেহারার জন্য কখনো স্ত্রী ভূমিকায়, কখনো বা ইংরেজ চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হত।” লিখেছেন, – ‘নটী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আসল হীরা ও মুক্তার গহনা পরেছিলেন। বোনেরা তাঁকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন ভিতর থেকে। মনোমোহিনী নটীর সাজে তিনি যখন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন তখন কে বলবে তিনি পুরুষ। মঞ্চে এসে তিনি যখন অপরূপা ভঙ্গিতে গ্রীবা নত করে দর্শকদের অভিবাদন করলেন তখন থেকেই নাটক জমে গেল।’
মনে রাখা দরকার ,সেকালের বহু অভিনেতাই নাটকের প্রয়োজনে স্ত্রী -চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শরচ্চন্দ্র ঘোষ , ক্ষেত্রমোহন গাঙ্গুলী , অমৃতলাল বসু ,অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বিবাহ উৎসব ও মায়ার খেলা নাটকে স্ত্রী ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন।
১৮৬৭ সালে অভিনীত ‘নবনাটকে’ তিনি শুধু নটীর ভূমিকায় অভিনয় করেননি, কনসার্টে এই প্রথম হারমোনিয়াম ব্যবহার করেন। বাংলা নাট্যমঞ্চে ও যাত্রায় পরবর্তীকালে যে বিদেশি যন্ত্রটি প্রধান যন্ত্রানুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রচিত প্রথম নাটক ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’। পরের বছর ২৬ এপ্রিল কলকাতার ন্যাশানাল থিয়েটারে যার প্রথম রজনী মঞ্চায়ন ঘটে। এইভাবে একে একে পুরুবিক্রম ,সরোজিনী, এমন কর্ম আর করব না (অলীক বাবু ), অশ্রুমতী, মানময়ী ,স্বপ্নময়ী, ধ্যানভঙ্গ, মালতীমাধব, মৃচ্ছকটিক , প্রিয়দর্শিকা, জুলিয়াস সিজার সহ মোট ৩২টি নাটক রচনা করেছেন ।
গণেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত হিন্দুমেলার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে নবগোপাল মিত্রের অনুরোধে ‘উদ্বোধন’ নামে একটি স্বদেশচেতনার স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। পরে এই হিন্দু মেলার যুগ্ম সম্পাদক এবং সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁর জীবনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৮৬৮ সালের ৫ জুলাই শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি হল ১৮৬৯ সালে তিনি আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক পদে আসীন হন। এরই ফাঁকে প্রতিষ্ঠা করেন গোপন সংগঠন ‘সঞ্জীবনী সভা’ (১৮৭১)।
স্ত্রীর বাল্য নাম ছিল কাদম্বিনী। ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী এই নাম বদলে কাদম্বরী রাখা হয়। এই বিদুষী রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন । পারিবারিক থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। সংস্কৃতি মনস্ক কাদম্বিনী ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে গবেষক মহলে আজও আলোচনা অব্যাহত।
এদিকে ব্রাহ্ম সমাজের তরুণ নেতা হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সমাজের কাজে ব্যস্ত হয়েছেন। রচনা ও সুরারোপ করেছেন একের পর এক ব্রাহ্ম সংগীতের। স্থাপন করেছেন ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ সংগীত বিদ্যালয়’। প্রকাশ করেছেন ‘স্বরলিপি গীতিমালা’ । এমন কি সংগীত বিষয়ক মাসিক পত্রিকা বীণাবাদিনী (১৮৯৭) প্রকাশিত হল। শৈশবে পণ্ডিত বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে তালিম নিয়েছিলেন। পিয়ানো , ভায়োলিন ও সেতারে তুখোড় মানুষটি ঠাকুর বাড়ির রবীন্দ্র-পূর্ব সংগীত- চর্চায় বিপ্লব আনেন। সহকারী ছিলেন অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও কিশোর রবি। রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যে ব্যবহৃত ২০টি গানে সুরারোপ করেন জ্যোতিদাদা। পরবর্তীকালে সংগীত-প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় সংগীত সমাজ।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদনা করতেন তত্ত্ব্ববোধিনী পত্রিকা। তারই সাথে সাথে ১৮৭৭ সালে পথচলা শুরু হল ‘ভারতী’ পত্রিকার। বকলমে সম্পাদকের প্রায় সমস্ত কাজই করতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সেই সূত্রে তখনকার কলকাতার প্রায় সব বিশিষ্ট লেখক ও কবির সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সম্পাদনার পরিধি বৃদ্ধি করেছেন তিনি। আগে প্রবন্ধ ,কবিতা ও গল্প -উপন্যাস ছাপা হত পত্রিকায়। তিনি গান ও তার স্বরলিপি এবং নাটক ও প্রহসন ছাপা শুরু করে দেন। তবে যখন যে কাজেই ব্যাপৃত থাকতেন, তার মধ্যেই অভিনয় ভাবনায় জারিত থাকতেন। বহু বিদেশি সাহিত্যকর্মের অনুবাদ করেছেন তিনি। ইংরেজি থেকে মার্কাস অরেলিয়াস -এর মেডিটেশন ও শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেন। শুধু নাটক নয়, ইতিহাস , দর্শন , ভ্রমণকাহিনী ,উপন্যাস ও ছোটগল্প ফরাসি ভাষা থেকে এবং সংস্কৃত থেকে সতেরোটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন।
চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর মূল্যায়ণ এখনো গবেষণার দাবী রাখে। পোট্রেট অঙ্কনে অসম্ভব দক্ষ ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের চেহারার যে সব স্কেচ সহজলভ্য তার বেশির ভাগই তাঁর আঁকা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিরিন্দ্রের দু’হাজার স্কেচ জাদুঘরে সংরক্ষিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই একবার ইংল্যান্ডে গিয়ে জ্যোতিদাদার আঁকা প্রচুর স্কেচ নিয়ে প্রদর্শনী করেন। উইলিয়াম রোদেনস্টাইন সেসব দেখে মুগ্ধ হন। তিনি তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে প্রকাশ করেন ‘টোয়েন্টি ফাইভ কলোটাইপস ফ্রম দি অরিজিনাল ড্রইংস অফ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরদার পথ অনুসরণ করে সফল উদ্যোগপতি হতে চেয়েছিলেন। ব্যর্থ হয়েছেন। নীলচাষ করে যখন লাভের মুখ দেখবেন ,তখন জার্মানিতে রাসায়নিক নীল আবিষ্কৃত হল, সরে এলেন জাহাজ ব্যবসায়। খুলনা ও বরিশালের ভেতর দিয়ে জলপথে পরিবহণ ব্যবসায় হইচই করে নেমে পড়েন। একে একে চালু হয় পাঁচটি স্টিমার- সরোজিনী, স্বদেশী , ভারত, বাংলা লক্ষ্মী ও লর্ড রিপন। ফ্লোটিলা নামক এক ইংরেজ কোম্পানি একই ব্যবসা শুরু করায় তিনি পিছু হটলেন। এছাড়াও দেশলাই এবং হাতে পাকানো কাপড় ব্যবসা চালু করেও ট্র্যাজিক হার মেনে নিতে হয় তাঁকে।
শেষ জীবনে দাদা সত্যেন্দ্রনাথের পদাংক অনুসরণ করে বাংলা মুলুক ছেড়ে নির্জন পাহাড়ে স্বনির্বাসিত হন তিনি। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের মোরাবাড়ি পাহাড়ের পাদদেশে ‘শান্তিধাম’ নামে একটি বাড়ি বানিয়ে সেখানেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। যাঁর গোড়ায় গলদ নাটক দেখে রসলাল অমৃতলাল বসু লিখেছেন —
“পরে শুধু অভিনয় , কাব্যে জ্যোতি কথা কয় /
সরস প্রকৃতি হ’তে হাসি ধারা ঝরে /
আঁখি মন অভিরাম গোড়ায় গলদ নাম /
প্রহসন লোকমন প্রফুল্লিত করে ।”★