Monday, May 20, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা- ১২১।। গোষ্ঠ পাল।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

চিনের প্রাচীর
গোষ্ঠ পাল বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন তিনি। মিডলসেক্সের সেন্টার ফরোয়ার্ড এলসন তাঁর পায়ের শট আটকানোর জন্য বুকে বল নিতে চেষ্টা করেন। ফল হয় মারাত্মক। কামানের গোলার মতো ধাবিত সেই শটের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে যান এলসন। সাময়িক বন্ধ হয়ে যায় ম্যাচ। চারদিকে হই চই পড়ে যায়। কিছুক্ষণ শুশ্রূষার পর উঠে বসেন অভিজাত সাহেব প্লেয়ার। যাঁর বুটহীন খালি পা থেকে সেদিন ঐ শট নিক্ষিপ্ত হয় তিনি গোষ্ঠ পাল (২০/০৮/১৮৯৬ — ০৮/০৪/ ১৯৭৬)।

পরাধীন দেশের অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলায় জন্ম। মাদারীপুর মহকুমার নড়িয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী বাবু শ্যামলাল পাল। মা -নবীনকিশোরী দেবী। ব্যবসার কাজে অধিকাংশ সময় বাবা কলকাতায় থাকতেন। গ্রামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে খবর পেয়ে স্যাকরার কাছে সোনার হার ও বালা গড়িয়েছিলেন। নব জাতকের মুখ দেখবেন। সে স্বাদ পূর্ণ হয়নি। তখনকার প্রাণঘাতী টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রয়াত হন।

মায়ের প্রযত্নে বড় হয়েছেন গোষ্ঠ পাল। সন্তানকে মানুষ করতে কুমোরটুলিতে নিয়ে চলে আসেন মা। বাড়ির কাছে সারদাচরণ এরিয়ান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করেন তিনি।

ফুটবলের প্রতি আজীবন ঝোঁক ছিল। গ্রামে অবসর সময়ে বল পায়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। কলকাতায় এসেও মিশে গেলেন খেলাপ্রেমীদের দলে। অন্তরের ব্ন্ধু সরোজ রায়ের সঙ্গে কুমোরটুলি পার্কের পশ্চিমদিকে গোলপোষ্টের পেছনের অংশে নিয়মিত অনুশীলন করতেন। এই সময় স্বামী বিবেকানন্দের বাণী গভীর ভাবে স্পর্শ করে তাঁকে। স্বামীজী বলতেন, ফুটবল মানুষকে স্বর্গের কাছাকাছি নিয়ে যায়। গোষ্ঠ এই বলের মধ্যেই হৃদয় খুঁজে পেলেন। দেশ থেকে উৎকণ্ঠিত মা মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে মাকে লুকিয়ে সাধনা জারি রাখতেন। প্রথম দিকে কুমোরটুলির হয়ে খেললেও মোহনবাগানে যোগ দিয়ে প্রতিভার যথার্থ বিচ্ছুরণ শুরু তাঁর। এখানকার খেলোয়াড় রাজেন সেন ছিলেন তাঁর দিশারি ।

২৯ জুলাই ।১৯১১। মোহন বাগান আই এফ এ শিল্ড বিজয়ী হয়। এই দলের সেন্টার হাফ ছিলেন রাজেন সেন। তিনি গোষ্ঠ পালের ট্যাকলিং ক্ষমতায় আবিষ্ট হন। পাশাপাশি লক্ষ করেন ,তাঁর পায়ে অসম্ভব জোরালো শট রয়েছে। তাই রাজেন সেন রাইট হাফে ব্যর্থ গোষ্ঠকে নিজের পাশে রাইট ব্যাকে স্থান করে দেন। এই পজিশনে ১৯১২থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩বছর দক্ষতার সঙ্গে বিরাজ করেছেন গোষ্ঠ পাল ।অনেকটা মাঠ জুড়ে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলতেন তিনি। মাঠে দর্শক আসতেন তাঁর খেলার টানে। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করতেন। তিনিও মোহন বাগান মাঠে নিয়মিত তাঁর খেলা দেখতে হাজির হতেন।

মোহনবাগান ক্লাবের সবুজ মেরুন জার্সি গায়ে চাপানোর বছর দেড়েকের মধ্যে মা নবীনকিশোরী ছেলের বিয়ে দিলেন। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে কিংবা বউভাতে ক্লাবের কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য। পরে মায়ের নাছোড় প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন – খেলিনা মা শুধু বল লাথাই আমি। খেলার মাঠে সিংহবিক্রমে দাপিয়ে বেড়াতেন গোষ্ঠ পাল। দারুণ অনুমান ক্ষমতা এবং ট্যাকলিং ছাড়াও সাইডপুশ ছিল ভয়ঙ্কর। মাঠের মধ্যে ইংরেজরা তাঁকে যমের মতো ভয় পেতেন।

পরাধীন দেশের অবদমিত, নিপীড়িত বাঙালি তাঁর কাছে ইংরেজদের নাস্তানাবুদ হতে দেখে আনন্দে গর্বে মেতে উঠতেন। প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে দল বেঁধে মাঠে যেতেন দর্শক। গোষ্ঠ পালের মধ্যে খুঁজে পেতেন বীর নায়ককে। তাই বাঙালি তার আঞ্চলিক বিভিন্নতা এবং ধর্ম বর্ণের অনৈক্য ভুলে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করবার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন বলিষ্ঠ চেহারার গোষ্ঠকে। গত শতকের বরেণ্য জাতীয় কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ ছিলেন তাঁর অন্যতম ফ্যান ।তিনি বলেছেন- গোষ্ঠ পাল হল জেল না -খাটা এক স্বাধীনতা সংগ্রামী ।

১৯২১ সালে মোহন বাগানের অধিনায়ক হন গোষ্ঠ পাল। টানা ৫বছর দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রোভার্স কাপে তাঁর খেলা দেখে মুগ্ধ এক ইংরেজ সাংবাদিক মন্তব্য করেন -হি ইজ এ্যাজ সলিড এ্যাজ দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথও তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে সহাস্যে বলেন -‘তুমিই তাহলে সেই চিনের প্রাচীর গোষ্ঠ পাল’। সেই থেকে লোকমুখে তাঁর নামের আগে এই বিশেষণ চিরদিনের জন্য যুক্ত হয়ে যায়। ১৯২৪ সালে প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে ঘোষিত হয় গোষ্ঠ পালের নাম। খালি পায়ে বুট পরা সাহেবদের সঙ্গে বহু স্মরণীয় যুদ্ধে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।

ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর, আই.এফ.এ.তে নাম নথিভুক্তির আগে তাদের জার্সি পরেও খেলেছেন গোষ্ঠ পাল। খ্যাতির শিখরে থাকা গোষ্ঠকে পরে তাদের দলে টানতেও চেয়েছেন তাঁরা। এই ক্লাবের বড় কর্তা তখন বনোয়ারি লাল রায়। একই মাঠে প্র্যাক্টিসের পর সম্পর্কে ভাগ্নে গোষ্ঠকে বলেন, ওঠ আমার গাড়িতে, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। পার্কস্ট্রিটে এসে গগনচুম্বি সব বহুতল দেখিয়ে বলেন, ‘পছন্দ করে ফেল, এই বাড়িগুলোর মধ্যে কোনটা নিবি। তোকে আমরা একটা বাড়ি দেব। সঙ্গে এক লক্ষ টাকা। তুই শুধু ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেল।’ গাড়ি থেকে নামেন গোষ্ঠ। বাড়ি পছন্দের অছিলায়। নিচে নেমে গাড়ির দরজা সপাটে বন্ধ করে গোষ্ঠ বলেন “মামা, আমি যদি জানতাম, তুমি এই প্রস্তাব দেবে, তাহলে কখনও তোমার গাড়িতে উঠতাম না। মোহনবাগান আমি ছাড়ব না।” কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের তাঁবুতে গোষ্ঠ পালের ছবির তলায় ভাস্বরলিপি হল,’ ‘ইস্টবেঙ্গলের প্রথম অধিনায়ক।’ সেই যে রেজিস্ট্রেশনের আগে খেলেছিলেন, তার স্মরণে এই ছবি সংরক্ষণ।

ফুটবল ছাড়াও নিয়মিত হকি, ক্রিকেট এবং টেনিস খেলতেন তিনি। মোহনবাগান ক্লাবে এই চারটি খেলাতেই কোনো না কোনো সময় তিনি অধিনায়কত্ব করেছেন। এই রেকর্ড অন্য কারো নেই। ক্যালকাটা ক্লাবের বিরুদ্ধে ধুতি পাঞ্জাবি পরে এক ওভারের প্রথম চার বলে দুই উইকেট শিকার করেন গোষ্ঠ পাল। এবার গোঁয়ার সাহেবরা ড্রেস কোড নিয়ে ঝামেলা শুরু করে দেয় হেরে যাওয়ার আতংকে।

তাঁর অবসর গ্রহণের ঘটনাটিও চমকপ্রদ। মোহনবাগান মাঠেই অভিজাত বৃটিশ দল ‘ক্যালকাটা ক্লাবের’ বিরুদ্ধে খেলা। সেই ম্যাচের রেফারি ক্লেইটন সাহেবের পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দুর্নাম ছিল যথেষ্ট। এদিনও তাই করছিলেন । মোহনবাগানের ফুটবলাররা বল পায়ে নিয়ে পেনাল্টি বক্সে ঢুকলেই বাঁশি বাজিয়ে আক্রমণ বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। বারংবার একই ঘটনা চলতে থাকে। প্রতিবাদে গোষ্ঠ পাল সহ সকলে মাঠে শুয়ে পড়েন। সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে এই ঘটনার। খেলার মাঠ থেকে প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে যায় জাতীয় জীবনে। রাজনীতির অঙ্গনে। সাহেব নিয়ন্ত্রিত আই.এফ.এ গোষ্ঠ পালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিলে অবসর ঘোষণা করে দেন গোষ্ঠ পাল।

তাঁর সময় মোহনবাগান বড় কোন টুর্নামেন্টে সেভাবে সাফল্য না পেলেও গোষ্ঠ পাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার একক দক্ষতা ও প্রতিভার কারণে। সমকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঙালি ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। তাঁর এই জনপ্রিয়তাকে বক্স অফিসে কাজে লাগাতে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরিচালক “গৌরীশংকর’ ছায়াছবিতে তাঁকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন। তাঁর নামে দেশে ডাকটিকিট চালু হয়েছে। কলকাতায় ইডেন গার্ডেনে ও মোহনবাগান মাঠের সামনে দিয়ে যাওয়ার রাস্তায় তাঁর মর্মরমূর্তি এবং পথের নামাঙ্কন ‘গোষ্ঠ পাল সরনি’ করা হয়েছে। ২০০৪ সালে মোহনবাগান ক্লাব তাঁকে মরণোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেছে।

১৯৬২ সালে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব পেয়েছেন তিনি। তখন এই খেতাব নিতে হলে ড্রেসকোড ছিল ‘গলাবন্ধ কোট’ পরে মঞ্চে হাজির হতে হবে। রাষ্ট্রপতির সচিবকে, নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেন গোষ্ঠ পাল। উত্তরে সচিব লেখেন, ‘ আপনি যে পোষাক পরেই আসবেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি তাতেই খুশি হবেন।’

প্রয়াণের পর, নিমতলা শ্মশানঘাটে লোকারণ্যের শেষ শ্রদ্ধায় দাহ করা হয় তাঁকে। কথিত আছে, সারা শরীর পুড়ে গেলেও দু’টো পা পুড়তে অনেক সময় লাগে। তখন বরেণ্য ফুটবলার শৈলেন মান্না মন্তব্য করেন,’ এ হল গোষ্ঠদার পা। একি সহজে পুড়বে!’★

- Advertisement -
Latest news
Related news