Tuesday, May 21, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা- ১২০।। সুকুমার সেন।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

ভাষাচার্য
সুকুমার সেন বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

দুই মহাপন্ডিত বাঙালির আড্ডা চলছে। একজন ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। অন্যজন দিকপাল সাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। হঠাত্‍ সেখানে হাজির হলেন এক তরুণ ছাত্র। সুনীতি বাবুর ছাত্র। তাঁকে দেখেই শহীদুল্লাহ’র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন সুনীতিস্যার। ‘এই যে ইনি আমার প্রশ্নে ভুল দেখিয়েছিলেন’। হ্যাঁ, বাস্তবে সেই ছাত্রটি স্যারের একটি প্রশ্নে ‘একটু ভুল’ ধরেছিলেন, একদিন। সেই অসামান্য প্রতিভাধর ছাত্রটির নাম সুকুমার সেন। অলোকসামান্য ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য বিশারদ সুকুমার সেন (১৬.০১.১৯০০ — ০৩.০৩. ১৯৯২)।

বাবা হরেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন আইনজীবী। মা নলিনী দেবী গৃহবধূ। কলকাতার গোয়াবাগানে মামার বাড়িতে জন্ম সুকুমারের। কিন্তু পৈত্রিক নিবাস ছিল পূর্ব বর্ধমানের গোতান গ্রামে। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা (১৯১৭) এবং বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করে কলকাতা চলে আসেন। এখানে সংস্কৃত কলেজ থেকে (১৯২১) সংস্কৃতে অনার্স পাশ করেন। প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থানে ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম. এ. পাশ করেন । এবার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন ।

১৯২৫ সালে ‘সিনট্যাক্স অব্ বৈদিক প্রোজ’ গবেষণা পত্রের জন্য প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়ে যান। এশিয়াটিক সোসাইটির মর্যাদাপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ। মধ্য ও আধুনিক (বাংলা ) আর্যভাষার ঐতিহাসিক পদবিচারের উপর দুরূহ গবেষণায় অর্জন করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী লেকচারার হন ১৯৩০এ। এখানে অধ্যাপনা করেন ২৮ বছর। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ছিলেন খয়রা অধ্যাপক। অবসর গ্রহণের পর ডেকান কলেজে বছর খানেক ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তারপর ত্রিবান্দ্রমের ইন্টারন্যাশান্যাল স্কুল অফ ড্রাভিডিয়ান লিংগুইস্টিক সংস্থায় একবছর অধ্যাপনা করেন।

সুনীতিকুমারের চিরকালীন অভ্যাস ছিল শিক্ষার্থীগণকে আপনি সম্বোধন। সেই পরম্পরা বহন করেছেন সুকুমার সেনও। ছাত্রদের ‘আপনি’ সম্ভাষণে আহ্বান করতেন ক্লাসে এবং সভা- সমিতিতে। বাড়িতে এবং আড্ডায়। সুরসিক মানুষটিকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন- ‘ও আমাদের সুনীতি বাবুর স্কুলের ব্যাপার। ও নিয়ে মাথা ঘামাবেন না’। জীবনে তিনজনকে প্রকৃত গুরু মানতেন সুকুমার। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, আই. জে. এস. তারাপুরওয়ালা এবং হেমেন্দ্রমোহন বসু। সুনীতি কুমারের সঙ্গে নানা বিষয়ে মাঝে মাঝে মতান্তর হলেও মনান্তর হতনা। একবার হয়েছিল। তখন সুকুমারের সহধর্মিনী সুনীলা সেন স্বামীকে বাধ্য করেন, গুরুর সাথে গোলমাল মিটিয়ে নিতে।

রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ সুকুমার আজীবন রবীন্দ্র দর্শন নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। রবিবাবুর গানের বাণীর ভাবমাহাত্ম্য নিয়ে ভেবেছেন সারা জীবন। রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র তাঁকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য্য’ উপাধিতে ভূষিত করে। শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা সুকুমার সেনের দুটি পুস্তক হল -রবীন্দ্রের ইন্দ্রধনু এবং রবীন্দ্রনাথ ও লোকসাহিত্য।

কবিগুরুর প্রথম সাক্ষাৎ লাভের ঘটনাটিও ছিল অভূতপূর্ব। ১৯২৩-২৪ সালের ঘটনা। বর্ধমান স্টেশনের ৪ নম্বর প্লাটফর্মে ট্রেন এসে দাঁড়ালো। প্রথম শ্রেণির কামরায় ভ্রমণ করেছিলেন সেদিন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আচমকা কামরায় ঢুকে কবিকে প্রণাম করেন তরুণ সুকুমার। কবি মুখ তুলে দেখবার আগেই ছুটে নেমে যান ট্রেন থেকে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সুকুমারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলা সাহিত্যের ব্যাপ্ত ইতিহাস রচনা। পাঁচটি খণ্ডে রচনা করেছেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। লিখেছেন -চর্যাগীতি পদাবলী, ইসলামি বাংলা সাহিত্য, প্রাচীন বাংলা ও বাঙালি ,বাংলা স্থাননাম, ভাষার ইতিবৃত্ত ,প্রবন্ধ সংকলন(১-৪খণ্ড ), শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত, বঙ্গভূমিকা, ভারত কথার গ্রন্থি মোচন, রামকথার প্রাক্ ইতিহাস, ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদি গ্রন্থ ।

বৈদিক ও ধ্রুপদী সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, বাংলা, আবেস্তা ও প্রাচীন পারসিক ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল সুকুমারের। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও পুরাণতত্ত্বের তিনি ছিলেন অথরিটি। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থে ড. সেনকে ‘ভাষাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তাঁর পূর্বোক্ত প্রাসঙ্গিক গ্রন্থগুলি ছাড়াও এবিষয়ে দুটি উল্লেখযোগ্য ইংরেজি গ্রন্থ হলো -Womens Dailect in Bengali এবং ‘A History of Brasabuli Literature. কান্তকবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম’ কাব্যের প্রাচীনতম পুথিটির আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। ভাবতে অবাক লাগে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বর্ধমান সাহিত্য সভার সংগ্রহে থাকা ১২ হাজার পুথি মন্থন করেছেন তিনি ,এক জীবনে। পুথিপাগল মানুষটির আর এক অনবদ্য কীর্তি হল ‘সেক শুভোদয়া’ সম্পাদনা ।

সুকুমারের গল্প সংগ্রহ যথেষ্ট চমকপ্রদ। খ্রিস্টীয় প্রথম দুই শতককে পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র হল কালিদাস। কেন কালিদাস ?এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন -প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে কবিরাই ছিলেন সর্বাপেক্ষা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তাই কালিদাসকে গোয়েন্দা নির্বাচন। এছাড়া গল্পের ভূত ,দিনের পর দিন যে গেল ,সুখের স্মৃতি ,বিশ্বসেরা উপকথার গল্প ইত্যাদি বিচিত্র ভাবনার গ্রন্থগুলি তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বর্ণস্বাক্ষর !

রসবোধে টইটম্বুর ছিলেন মানুষটি। মজা করে বলতেন আমরা লক্ষ্মণ সেনের বংশধর। আড্ডায় আক্ষেপ করে জানাতেন কৈশোরে সাধ ছিল রেলের ইঞ্জিন ড্রাইভার হওয়ার। পরে ভেবেছিলেন গণিতজ্ঞ হবেন। হলেন ভাষাচার্য। তাও আবার সংস্কৃতের স্কলার। সুকুমারের বয়ানে – ‘আমি হোম বেকড স্কলার’। বিশ্ববন্দিত ভাষাবিজ্ঞানী হলেও কখনো দেশের বাইরে পা দেননি নবতিপর মানুষটি। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন উপাচার্য্য। বিদেশ যাওয়ার জন্য সুনীতিকুমার তাঁর নিজের ও সুকুমার সেনের নথিপত্র নিয়ে যান তাঁর কাছে। ব্যস্ত আশুতোষ বলেন, ‘পরের সপ্তাহে পাটনা যাচ্ছি। ফিরে ব্যবস্থা করছি’। ফেরা হয়নি। পাটনাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আশুতোষ। পরে কোনোদিন দেশ ছাড়বার কথা সেভাবে ভাবেননি সুকুমার সেন। চালু করেন ‘হোমসিয়ানা ক্লাব’। ভোজনপ্রিয় মানুষটি কচুরি ও লুচির সংকর পদ ‘লুচুরি’ উদ্ভাবন করেন। গিমে শাক, গুগলির চচ্চড়ি এবং ছাতুর তরকারি পেলে চেটেপুটে খেতেন।

নানা সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন সুকুমার সেন। আনন্দ পুরস্কার ,রবীন্দ্র পুরস্কার, রামেন্দ্রসুন্দর স্মৃতি পুরস্কার, সরোজিনী মেডেল, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত যদুনাথ সরকার পদক , বিদ্যাসাগর পুরস্কার এবং বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উপাধি অগ্রগণ্য। লন্ডনের এশিয়াটিক সোসাইটিও ১৯৮৪ সালে তাঁকে স্বর্ণ পদক প্রদান করে। তবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই সাহিত্য ও ভাষা বিশারদকে যোগ্য মর্যাদা প্রদান করা হয়নি, মনে হয়।

তার কারণ কী ? রাজনীতি সচেতন প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের ঘনিষ্ঠ ব্ন্ধু হয়েও ডান -বাম কোনো রাজনীতির দিকে কখনো আগ্রহ দেখাননি সুকুমার সেন। জীবনের শেষ বেলায় যখন প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ইংরেজিকে বিদায় দেওয়া হলো এই বাংলায়, অবিচল থাকতে পারেননি সুকুমার সেন। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। যুগান্ত পেরিয়ে এখন বাঙালি অনুধাবন করেন হাড়ে হাড়ে – কতখানি দূরদর্শী ছিলেন এই ‘লক্ষ্মণ সেনের বংশধর’ ।

- Advertisement -
Latest news
Related news