Tuesday, May 21, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১৭।। শিশির কুমার ভাদুড়ী।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

ক্ষণজন্মা নাট্যশিল্পী
শিশিরকুমার ভাদুড়ীবিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

খবর কাগজে প্রকাশিত হল, এক জনপ্রিয় প্রবীণ বাঙালী নাট্যবেত্তা ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হতে চলেছেন। এদিকে সেই শিল্পী সম্মান গ্রহণে নারাজ। ২ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ তারিখে দীর্ঘ পত্র লিখলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব বি. এন. ঝা. কে। যার শেষ অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছিলেন ‘যে আদর্শকে আমি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অনুসরণ করে আসছি, সরকার যদি আমার মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে সত্যিই উৎসুক হতেন, তাহলে কলকাতা মহানগরীতে একটি জাতীয় নাট্যশালা স্থাপন করলেই উপযুক্ত হোত। আমি এই খেতাব গ্রহণ করতে পারিনা।’ (বঙ্গানুবাদ- নির্মলচন্দ্র ঘোষ )। এই মহান উন্নতশির মানুষটির নাম নাট্যাচার্য্য শিশির কুমার ভাদুড়ী (জন্ম -২অক্টোবর ১৮৮৯ ★ মৃত্যু -৩০জুন ১৯৫৯)।

হাওড়ার রামরাজাতলায় বাড়ি হলেও জন্মেছিলেন মেদিনীপুর শহরে, মামা বাড়িতে। বাবা – হরিপদ ভাদুড়ী। মা – কমলমণি। পি. ডব্লিউ. ডি. দপ্তরের ইঞ্জিনিয়র বাবা ছিলেন স্পষ্টবাদী ও স্বাধীনচেতা। বাঙালি সম্পর্কে কটু মন্তব্য করায় এক ব্রিটিশ সহকর্মীকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। যার ফলে চাকরি হারাতে হয়। পরে মার্টিন কোম্পানিতে যোগ দেন। বাবার সেই মেজাজটাই পেয়েছিলেন তিনি। নিন্দুকেরা তাঁকে অনেক ক্ষেত্রেই বদমেজাজি ও দাম্ভিক বলে সমালোচনা করতে ছাড়েননি।

কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর স্কটিশচার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ইংরেজি নিয়ে। পাঠজীবনের শেষ বছরে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কলকাতার টাউন হলে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে। কবিকে সংবর্ধিত করবার জন্যে এই সভায় রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুন্ঠের খাতা ‘ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের জুনিয়র সদস্যগণ। নাটকে শিশির কুমার ‘কেদার’ চরিত্রে অভিনয় করেন। মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ প্রশংসাপত্রে সেদিন লিখেছিলেন – কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। ঐ পাটে আমার যশ ছিল।’

বাচিক শিল্পী হিসেবে তাঁর হয়ে ওঠা রবীন্দ্র সৃষ্টির অনুধ্যানে। সমসময়ে নবীনচন্দ্র সেনের কবিতাকেই আবৃত্তিযোগ্য শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হত ।শিশির কুমার সেই ধারণা বদলে দেন। রবীন্দ্রনাথের বড় বড় কবিতা সুললিত কণ্ঠে আবৃত্তি করে মন্ত্রমুগ্ধ করতেন তিনি। ইংরেজি সাহিত্যের তরুণ অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও মনোজগৎ জুড়ে থাকত -অভিনয়। রবীন্দ্রপ্রভাব , শেক্সপিয়র চর্চা এবং নাট্যগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের নিবিড় সান্নিধ্যে শেষ পর্যন্ত অধ্যাপনায় ইস্তফা দিয়ে অভিনয়কেই ‘পেশা’ হিসেবে বেছে নেন।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে নাট্য শিক্ষক মন্মথ নাথ বসু ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর পরামর্শ নিয়েছিলেন। আশুতোষ তাঁকে বলেন – ‘যদি তুমি ডিসাইড করে থাক যে , স্টেজে জয়েন করবে, তাহলে বলবো যে সব পেশাই সম্মানজনক।’ এরপর আর দ্বিধা করেননি। অধ্যাপনা করে মাসিক বেতন পেতেন দেড়শ’ টাকা। ম্যাডান থিয়েটার শিশির কুমারকে মাসে সাতশো টাকা বেতন প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় ।

১৯৫১ সালে তাঁর পরিচালনায় অভিনীত ‘ভীষ্ম’ নাটক দেখে সেকালের বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ অবাক হয়ে যান। পুরোপুরি পেশাদার হওয়ার আগে তাঁর পরিচালনায় ‘পান্ডবের অজ্ঞাতবাস’ মঞ্চস্থ হয়। বাংলা রঙ্গালয় পেয়ে যায় একজন অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিমান প্রয়োগকর্তা, প্রতিভাশালী নাট্যশিক্ষক ও সুদক্ষ অভিনেতাকে।

পার্শি ধনকুবের জে. এফ. ম্যাডানের নাট্য প্রেক্ষাগৃহ কর্নওয়ালিস থিয়েটার সেসময় কলকাতায় ছিল আধুনিকতম প্রেক্ষাগৃহ ।এখানেই নৃপেন বসু ,সত্যেন দে, মনমোহন গোস্বামীর মতো বলিষ্ঠ অভিনেতা ও বসন্ত কুমারীর মতো প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীদের সঙ্গে ‘ চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে চাণক্য চরিত্রে অভিনয় করে নাট্যামোদী দর্শকদের চিত্ত জয় করেন শিশির কুমার। আধুনিক বাংলা থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্ব সূচিত হয় এবার। নিজে নাট্যদল গঠন করেন। এই দলের প্রথম প্রযোজনা -‘বসন্তলীলা’। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে ‘আলফ্রেড মঞ্চে’ তা অভিনীত হয়। নাটকের উদ্বোধন করেন দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশ। নাটকের আগে কবি নজরুল ইসলাম স্বকণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করেন সেদিন।

শিশির কুমার এরপর তৈরী করেন ‘নাট্যমন্দির’। তাঁর পরবর্তী নাট্যজীবন নাট্যমন্দির, নব নাট্যমন্দির ও শ্রীরঙ্গমে ত্রিধাভক্ত (ঐ শ্রীরঙ্গম পরে বিশ্বরূপা নামে হাতবদল হয়ে যাবে)।১৯৪১ সাল থেকে ১৯৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি শ্রীরঙ্গমেই নাট্য পরিচালনা ও অভিনয় করে যান। জীবনের শেষ নাট্য অভিনয়ও ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। আলমগীর। প্রায় ৩৮ বছর তিনি পেশাদারি নাট্যজীবনে পঞ্চাশটিরও বেশি নাটক প্রযোজনা করেন। বৈচিত্র্যের সন্ধানী এই নাট্যবেত্তা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর পাষাণী, সাজাহান , গিরিশচন্দ্র ঘোষের জনা ,পান্ডবের অজ্ঞাতবাস , রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন , শেষরক্ষা, যোগাযোগ , চিরকুমার সভা এবং শরৎচন্দ্রের ষোড়শী ও রমা মঞ্চস্থ করেছেন।

শুধু কায়িক ও বাচিক অভিনয় নয়, গভীর নাট্যজ্ঞান , সাহিত্যবোধ , নাটকের মঞ্চে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন , আলোর ব্যবহার , মঞ্চ শৈলী, সংগীতের ব্যবহার – সামগ্রিক বিষয়গুলিকে নিয়ে সংহতি স্থাপনে ব্যাপৃত ছিলেন তিনি। নাটকের সব চরিত্রের প্রতি সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি সংলাপের শিষ্ট উচ্চারণ পরিশীলিত বাচনভঙ্গি ,মঞ্চে চরিত্রগুলির সঞ্চরণ সব ক্ষেত্রেই নিরলস প্রশিক্ষণ দিতেন এই নাট্য শিক্ষক। সিল্কের লুঙি, ফুল পাঞ্জাবি , বুকের একধারে বোতাম লাগানো শার্ট পরে মহলা দিতেন তিনি। সহ অভিনেতাদের বলতেন -‘তোমরা তোমাদের অন্তরের অনুভূতি দিয়ে তোমাদের ভূমিকাকে জীবন্ত করে তুলবে। ‘ প্রখ্যাত রুশ নাট্য পরিচালক স্তানিস্লাভস্কির মতো তিনিও চরিত্রগুলির ইমোশনাল ইনভলমেন্ট এর অনুসারী ছিলেন । শরৎচন্দ্র যথার্থ বলেছেন – ‘শিশির যতবড় না অভিনেতা, তার চেয়েও উনি অনেক বড় নাট্য শিক্ষক’।

রবীন্দ্রনাথের শেষরক্ষা নাটক মঞ্চায়নের সময় এদেশের নাট্য মঞ্চে তিনিই প্রথম শেষ দৃশ্যে দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে সকলকে একাকার করে দেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সীতা নাটকটি নিয়ে তিনি এতরকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন যা যে কোনো গবেষকের চর্চার পরিসর হয়ে ওঠে। এই নাটকে রামের ভূমিকায় অভিনয়ও করতেন তিনি। ‘সীতা’ নাটকটি দেখে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া -‘সীতা নাটক নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু শিশিরের প্রয়োগ নৈপুণ্যে আমার শ্রদ্ধা এল’। এই সীতা নাটক মঞ্চস্থ করবার জন্য ১৯৩০ সালের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন শিশির কুমার। এদেশের কোনও নাট্যদলের সেই প্রথম হাতিয়ার নিয়ে বিদেশ যাত্রা। ২৩ জন সহশিল্পী নিয়ে সীতা মঞ্চস্থ করেন ভ্যান্ডারবিল্ট থিয়েটারে। নবপর্যায়ে সীতা মঞ্চায়নের পূর্বে তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ উপন্যাস বহুমাত্রিক এই মানুষটির রক্তমাংসের আদল ও জীবন যন্ত্রণাকে আখ্যায়িত করেছে।

বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালনা ও চিত্রাভিনয়েও তাঁর অবদান যথেষ্ট। শরৎ কাহিনী অবলম্বনে ‘আঁধারে আলো’ পরিচালনা করেন নরেশ মিত্রের সাথে যৌথ ভাবে। এছাড়াও সীতা (১৯৩৩), চাণক্য (১৯৩৯), মোহিনী (১৯২৯), বিচারক (১৯২৮) তাঁরই পরিচালনায় চিত্রায়িত হয়। ১৯৩৭ সালে নির্মাণ করেন ‘টকী অফ টকীজ’। চিত্র জগতে শোনা যায় , প্রখ্যাত অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়কে তিনিই প্রথম মঞ্চ থেকে চিত্র জগতে নিয়ে আসেন।

বিশ্ব নাট্যচর্চার খুঁটিনাটি খবর রাখতে প্রতি রবিবার ‘সানডে টাইমস’ খুঁটিয়ে পড়তেন মানুষটি। শেষ স্বপ্ন ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ‘রথের রশি’ মঞ্চায়নের। সেই লক্ষ্যে সোমেন ঠাকুরের সহায়তায় ‘শ্রী অঙ্গনম’ নামে নাট্য সংগঠন তৈরি করেন। মহলা শুরু হলেও মঞ্চায়নের পূর্বে মৃত্যু হয় তাঁর ।★

- Advertisement -
Latest news
Related news