Wednesday, May 22, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১৬।। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

পেশাদার পটো
দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীবিনোদ মন্ডল                                                                                         “চিত্রশিল্পী সম্মান পেলেও অন্য রূপকারের উপযুক্ত মর্যাদা আমরা এখনও দিই না। মাটির কলসি যে গড়ল তাকে আমরা কুমোর বলেই অবহেলার চক্ষে দেখেছি , কাপড়ের পাড়কে যে সুন্দর করে তুলল তাকে শুধুই তাঁতি বলেই জেনেছি , লোহার তৈজসাদি যে গড়েছে তাকে কামার ছাড়া আর কিছু ভাবিনি; কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব দান আমাদের জাতীয় সম্পদের দিক দিয়ে কম নয়।” ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিত্রকলা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই মননশীল বিশ্লেষণ করেছেন যিনি, তিনি ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী (জন্ম ১৫ জুন ১৮৯৯, মৃত্যু -১৫ অক্টোবর ১৯৭৫)।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বাংলার সৃজন – সংস্কৃতির ইতিহাসে দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী অবিস্মরণীয় নাম। সভা -সমিতিতে সবিনয়ে নিজেকে পেশাদার পটো পরিচয়ে বিশেষিত করতেন মানুষটি। কিন্তু তাঁর বৌদ্ধিক চর্চার ক্ষেত্র ছিল দিগন্ত প্রসারিত। তিনি ছিলেন বিশ্ব মানের চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। অসাধারণ কার্টুনশিল্পী। নন্দনতত্ত্ব বিশারদ। প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য শিল্পকলার সুদক্ষ শিক্ষক । অধুনা বাংলা দেশের রংপুরে জন্ম দেবীপ্রসাদের। তাজহাট গ্রামে। ধনাঢ্য পরিবারে। কৈশোর থেকেই ঝোঁক ছিল চিত্রশিল্পের প্রতি। মামা রাজাবাহাদুর গোপাললাল রায় ছিলেন তাজহাটের তৎকালীন রাজা। প্রিয় ভাগ্নে শিল্পকলাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করবে শুনে বলেছিলেন -‘তুমি আমাদের বংশের কুলাংগার। ছবি আঁকাকে তুমি বাঁচার সাথী করে নেবে যদি ভেবে থাক তাহলে নিশ্চিন্ত জেনো এ বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য পাবেনা’। এই ভাগ্নেই একদিন মাতুল রাজার কোনো সাহায্য ছাড়াই জীবন সংগ্রামে সফল হয়েছেন , অর্জন করেছেন পদ্মভূষণ (১৯৫৮) রাষ্ট্রীয় সম্মান ।

দেবীপ্রসাদের বাবা উমাপ্রসাদ রায়চৌধুরী ছিলেন ডায়মন্ডহারবার অঞ্চলের মুড়াগাছার জমিদার। তিনি মাতুলালয় থেকে সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। প্রশান্ত-প্রশ্রয়ে সন্তানের লক্ষ্য পূরণে পাশে দাঁড়ান। তাঁকে নিয়ে একদিন হাজির হন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। শিল্পাচার্য্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে সমর্পণ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যতটুকু হয়েছিল বাড়িতেই। এরপর শুরু হয় শিল্পসাধনা।

দেবীপ্রসাদের প্রথম দিকের চিত্রশিল্পে তাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুসরণ পরিলক্ষিত হয়। যদিও অচিরেই স্বকীয় পথে স্বরাট হয়ে ওঠেন তিনি। কিছুদিন ভাস্কর্যের শিক্ষা নেন হিরোমনি চৌধুরীর কাছে। এরপর পাশ্চাত্য শিল্পকলার গভীর অনুশীলনের জন্যে ইতালী যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ভর্তি হন বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট এ।

তীব্র শিল্প ক্ষুধা নিয়ে পাড়ি দেন দক্ষিণে। গন্তব্য মাদ্রাজের সরকারি আর্ট স্কুল। সালটা ১৯২৮। ছাত্র হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেন, বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেখানকার সুপারের চাকরিতে বহাল হন (১৯২৯)। এরপর একে একে বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ এবং অধ্যক্ষের আসন অলংকৃত করেন দেবীপ্রসাদ। অবসর গ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালে। ইতোমধ্যে সদ্য স্বাধীন দেশে শিল্পকলা চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ নির্মাণে গঠিত হয় ললিত কলা একাদেমি (১৯৫৫)। এই একাদেমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্বভার অর্পিত হয় মাদ্রাজ সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ দেবীপ্রসাদের হাতে। ১৯৫৫ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর আর্ট সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। বহুপূর্বে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ থাকবার সময় অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (MBE)এর সদস্য পদ লাভ করেন তিনি (১৯৩৭)।

তুলির পাশাপাশি কলমেও নিয়মিত চারণা করেছেন দেবীপ্রসাদ। তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকায় ‘একখানি চপ’ নামে। সে সময় ভারতবর্ষ, প্রবাসী, মৌচাক এবং শনিবারের চিঠি’র তিনি ছিলেন নিয়মিত লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -পিশাচ ,মাংসলোলুপ ,পোড়ো বাড়ি ,বল্লভপুরের মাঠ। তাঁর অন্য একটি প্রণয়কেন্দ্র ছিল জঙ্গল। প্রবাসী কার্যালয় থেকে এই ‘জঙ্গল’ শিরোনামে তাঁর একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। সেকালে জনপ্রিয় হয়েছিল এই গল্প সংগ্রহ। এতে শিকার বিষয়ক চোদ্দখানি মনোগ্রাহী গল্প সংকলিত রয়েছে।

১৯৫৬ সালে চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত সাহিত্য সম্মিলনীতে তিনি সভাপতিত্ব করেন।

তিনি অবনীন্দ্রনাথের নব্যবঙ্গীয় চিত্র শৈলীকে অতিক্রম করে ভারতীয় শিল্পকলাকে আধুনিকতার উৎসমুখে উত্তীর্ণ করেছেন। একসময় তাঁর মনে হয়, ভারতীয় শিল্পশৈলীতে ‘ফিজিক্যাল রিয়েলিটির’ অস্তিত্ব বড়ো কম। তাঁর ‘নির্বাণ’ সেই অভাব পূরণে উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। এখানে একটি বুদ্ধমন্দিরের অন্ধকার প্রায় গর্ভগৃহে মুণ্ডিত মস্তক কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকের মোক্ষ লাভের সুতীব্র ব্যাকুল আর্তিময় আগ্রহ প্রতিফলিত ।স্থাপত্য স্তম্ভের ফাঁক দিয়ে যে আলো এসে পড়েছে ভিক্ষুকের মুখে তাতে স্বর্গীয় সুষমা উদ্ভাসিত যেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান -মা ,শারদপ্রতিমা, জীবন সন্ধ্যা ,সুরের নেশা, গাড়ি ইত্যাদি।

ভাস্কর হিসেবে বহু শিল্প রসিক তাঁর সৃষ্টিতে ফরাসি ভাস্কর ওগুস্ত রদ্যাঁর প্রভাব খুঁজে পান। দেশে বিদেশে তাঁর ভাস্কর্যগুলি লক্ষ কোটি মানুষের শিল্প ক্ষুধা নিরসনে স্থাপিত রয়েছে। প্রসিদ্ধ বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য গুলি হল- শ্রমের বিজয় , মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি , যে দুটি চেন্নাই সমুদ্র সৈকতে স্থাপিত। এছাড়াও পাটনায় শহিদ স্মারক ,দিল্লিতে লবণ সত্যাগ্রহ স্মারক, ইত্যাদি।

সুপ্রসিদ্ধ পাটনা সেক্রেটারিয়েটের সামনে প্রতিষ্ঠিত ভাস্কর্যের ছবিকে ভারত সরকার ১৯৬৭ সালের ১ অক্টোবর Quit India নামে ডাকটিকিটে ব্যবহার করে দেবীপ্রসাদকে সম্মানিত করেছে। তাঁর আর একটি অসাধারণ কাজ হল -Modern column, ছাব্বিশ টন ভারি ব্রোঞ্জের এই স্থাপত্য ১৯৮১ সালে দিল্লীর সর্দার প্যাটেল মার্গ ও উইলিংডন ক্রিসেন্ট রোডের সংযোগ স্থলে স্থাপিত হয়েছে। তাঁর শিল্প কর্মগুলি সরকারী জাদুঘর , চেন্নাই, দিল্লী, সালার, হায়দ্রাবাদ, ত্রিবাংকুর এবং কলকাতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে।

শিল্প সম্পর্কিত দেশি বিদেশি নানা গ্রন্থে তাঁর শিল্পকর্মের পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। জয়া আপ্পাস্বামীর সাথে যৌথ ভাবে তিনিও শিল্প ও নান্দনিকতা বিষয়ে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। দেবীপ্রসাদের কার্টুন চিত্রগুলিও স্বকীয়তায় ভাস্বর। ১৯৭৮ সালে তাঁর চল্লিশটি কার্টুন নিয়ে মুদ্রিত হয়েছে ‘Cartoons of Deviprasad’ সংকলন। কার্টুন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ঋজুরেখ- ‘অনেকের ধারণা কার্টুন বা ব্যঙ্গ চিত্রে বিষয় বস্তুই ছবির মুখ্য উদ্দেশ্য, প্রকাশ কৌশল গৌণ , যেমন তেমন করে তুলি চালালেই হল। এই ধারণাটা ভিত্তিহীন, প্রমাণ স্বরূপ বলতে পারি সার্কাসে যে ক্লাউন এর খেলায় নামে সে-ই ওস্তাদ খেলোয়াড়। কার্টুন ছবির প্রকাশভঙ্গির নিজস্ব সত্তা আছে, যা হিজিবিজির নামান্তর নয়।’

গোপাল সেন ,প্রদোষ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন প্রমুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের পথ প্রদর্শক ছিলেন তিনি। তাঁর অন্যতম সাহসী পদক্ষেপ হল চেন্নাই সরকারি আর্ট স্কুলের আমূল সংস্কার। সেখানে তিনিই এদেশে প্রথম ন্যুড স্টাডির ব্যবস্থা করেন, যা তৎকালীন রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজের কাছে ছিল অভাবনীয় পদক্ষেপ।★

- Advertisement -
Latest news
Related news