Wednesday, May 22, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১৪।। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

নিসর্গপ্রেমিক
বিভূতিভূষণ বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

জনপ্রিয় সাহিত্যিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দেন এক তরুণী। বাঙালি সেই সাহিত্যিক আশীর্বাণী লেখেন -‘গতিই জীবন, গতিদৈন্যই মৃত্যু’। শুরু হয় বন্ধুত্ব — পত্র বিনিময়। নাছোড় তরুণী এক সময় বিয়ের প্রস্তাব দেন। লেখক তখন ৪৭, প্রেমিকা অষ্টাদশী। তাতে কি ! ‘আপনাকে মাত্র দশ দিনের জন্য স্বামী হিসেবে পেলে আমি ধন্য’ !

১৯৪০ এর ৩ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২.০৯.১৮৯৪ — ০১.০৯.১৯৫০)।

কল্যাণী (রমা ) দেবীর সঙ্গে দাম্পত্যের স্মৃতি একমাত্র সন্তান তারাদাস (বাবলু )। প্রথম স্ত্রী গৌরিদেবীর (১৯১৭-১৮) মৃত্যুর ২৩ বছর পর দ্বিতীয় বিয়ে। তবু তাঁকে মনে রেখেছিলেন বিভূতিভূষণ। বিহারের ঘাটশিলায় যে বাড়িতে লেখক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন – তার নাম দিয়েছিলেন ‘গৌরীকুঞ্জ’।

বিভূতিভূষণ জন্মেছিলেন উত্তর ২৪পরগনার হালিশহরের কাছে -মুরাতিপুরে মামাবাড়িতে। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। পেশা ছিল পৌরোহিত্য ও কথকতা। মা মৃণালিনী দেবী ছিলেন গৃহবধূ । সংস্কৃতে বিশেষ বুৎপত্তির জন্য মহানন্দ ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। বাবার কাছেই বর্ণপরিচয় বিভূতিভূষণের। বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। আই. এ. পাশ করেন রিপন কলেজ থেকে (১৯১৬)। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. (১৯১৮) ডিগ্রি অর্জনের পর এম.এ. এবং আইনে ভর্তি হন। তবে অচিরেই তা ছেড়ে দেন।

মূলত শিক্ষকতার পেশায় ব্যস্ত থাকলেও বিচিত্র জীবিকা নির্বাহের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। যা তাঁর সৃষ্টিকে লীলায়িত করেছে। কেশোরাম পোদ্দারের গোরক্ষিনী সভার প্রচারকের কাজ করেছেন। খেলাৎচন্দ্রের বাড়িতে কিছুদিন গৃহ শিক্ষকতা করেছেন। পাশাপাশি তাঁর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভাগলপুরের জমিদারিতে এস্টেট ম্যানেজারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন কিছুদিন। মূলতঃ অরণ্যনিধনের চাকরি করতে গিয়ে লিখে ফেলেছেন নিসর্গপ্রেম ও বনভূমি সৃজনের অনন্য আখ্যান ‘আরণ্যক’। শিক্ষকতা করেছেন হুগলী জেলার জঙ্গীপুর হাইস্কুলে, সোনারপুরের হরিণাভি স্কুলে এবং কোলকাতার খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে।

বহু প্রচলিত প্রবাদ আছে খুলিলে মনের দ্বার না লাগে কপাট। কথাটি বিভূতিভূষণ সম্পর্কে ভীষণ প্রযোজ্য। সেই যে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ বাঙালি পাঠকের হৃদয় জয় করে নেয়, তারপর আর লেখককে পেছনে তাকাতে হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র এভাবেই দুর্গেশনন্দিনী লিখে পাঠকের দরবারে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। বিভূতি ভূষণের প্রথম প্রকাশিত গল্পটির নাম ‘উপেক্ষিতা’। ১৯২২ সালে প্রবাসী পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় লেখাটি ছাপা হয়।
পথের পাঁচালী লেখা শুরু করেন ১৯২৫এ। ভাগলপুরে থাকবার সময়। শেষ হয় ১৯২৮এ। ‘বিচিত্রা’ সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লেখাটিকে পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। ধারাবাহিক। গ্রন্থরূপ লাভের প্রাক্কালে এর বিজ্ঞাপণ ছাপা হয় – “শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাঙলা ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের উপন্যাস। শিশুমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপ ভাবে উদ্ঘাটিত করেন নাই । অন্য দেশে কেহ করিয়াছেন কি না আমাদের জানা নাই। ” পাঠ প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন –‘ বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে’।

পথের পাঁচালী গ্রন্থটি শেষ করতে তাগাদা দিতেন তাঁর মেস জীবনের ঘনিষ্ঠ ব্ন্ধু নীরদ সি. চৌধুরী। সেসব কাহিনী বিধৃত রয়েছে নীরদের ‘দাই হ্যান্ড গ্রেট এনার্ক’ গ্রন্থে। তবে এই উপন্যাসকে বিশ্বের দরবারে ব্যাপক পরিচিতি দান করেছেন সত্যজিৎ রায় ,চলচিত্রায়নের মাধ্যমে। লেখকের পরবর্তীকালে লেখা ‘অপরাজিত'(২ খণ্ড ১৯৩২)উপন্যাস নিয়েও সত্যজিৎ ছবি করেছেন। এ যেন লেখকের আত্মজৈবনিক সাহিত্য। ভারতবর্ষের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এবং বিশ্বের নানা বিশিষ্ট ভাষায় অনূদিত হয়েছে ‘পথের পাঁচালী’। বাংলা গ্রামীণ সংস্কৃতির বিচিত্র মাধুর্য ,পল্লী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ,সহজ সরল দারিদ্র্য লাঞ্ছিত জীবনের পদাবলি ধরা পড়েছে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ সহ সমগ্র রচনাবলিতে।

সারা জীবনে রচনা করেছেন ১৫ খানি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ৭টি কিশোর উপন্যাস। ২০০ ছোট গল্প। এছাড়াও আছে ভ্রমণ কাহিনী ,ডায়েরি, প্রবন্ধ এবং অনুবাদ সাহিত্য ।তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে পূর্বে বর্ণিত দুটি ছাড়াও দৃষ্টি প্রদীপ (১৯৩৫), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল( ১৯৪০), বিপিনের সংসার (১৯৪১), দেবযান (১৯৪৪) এবং ইছামতী (১৯৫০) বহু পঠিত। প্রকাশিত প্রথম গল্প গ্রন্থ হল –মেঘমল্লার (১৯৩১) এছাড়াও মৌরিফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), কিন্নরদল (১৯৩৮) যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর ভাবুক মনের কাব্যিক দ্যোতনায় ভরা দুটি অপরূপ গ্রন্থ স্মৃতির রেখা (১৯৪১) এবং উৎকর্ণ (১৯৪৬)।

কিশোর -কিশোরীদের মনের মণিকোঠায় স্বতন্ত্র আসন পাতা আছে বিভূতিভূষণের জন্য। তাঁর কিশোর সাহিত্য সম্ভার ভারে নয় – ধারে অতুলনীয়। চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮), মরণের ডংকা বাজে (১৯৪০), বনে -পাহাড়ে (১৯৪৫) এবং হীরা মানিক জ্বলে (১৯৪৬) অপূর্ব সৃষ্টি। চাঁদের পাহাড় রচনার জন্য তাঁকে আফ্রিকা যেতে হয়নি। দূরদর্শী লেখক এইচ. এইচ. জনস্টন এবং রোসিটা ফোবর্স প্রমুখ পর্যটকের বই মন্থন করেছেন। নিবিড় অনুশীলনের ফসল এই কিশোর উপন্যাস। আফ্রিকার ভূপ্রকৃতি, জঙ্গল ,নদী, আগ্নেয়গিরির লাভালীলার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ‘চাঁদের পাহাড়’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে উপন্যাসটির নবীকরণ ঘটিয়েছেন। যেখানে একালের জনপ্রিয় অভিনেতা ‘দেব’ নাম ভূমিকায় (শঙ্কর ) অভিনয় করেছেন।

প্রথম স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু এবং পরে পরে ছোট বোন মণির মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন লেখক। জীবন যাত্রায় এক ধরনের উদাসীনতা ও সন্ন্যাস ভাব আসে। পরলোকচর্চা, জ্যোতিষচর্চা, নিয়তিবাদ নিয়ে পড়াশুনায় মেতে ওঠেন। বেঁচে থাকবার রসদ খুঁজতে যখন তখন চলে যেতেন প্রকৃতির নির্জনে। জঙ্গল ভ্রমণে ! এমনই অভিজ্ঞতায় ভরা তাঁর ‘দেবযান’ উপন্যাস। রাতে ভিতে গাছের ডালে বসে আকাশ ও গাছেদের নিশীথ অভিসার পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উচ্চারণ “অরণ্যই ভারতের আসল রূপ। সভ্যতার জন্ম হয়েচে এই অরণ্য- শান্তির মধ্যে বেদ ,আরণ্যক ,উপনিষদ জন্ম নিয়েছে এখানে – এই সমাহিত স্তব্ধতায় -নগরীর কোলাহলের মধ্যে নয় ।”

জীবনের শেষ দশ বছর কাটিয়েছেন ব্যারাকপুরে। তখনই লিখেছেন অশনি সংকেত ও ইছামতীর মতো জনচিত্তজয়ী রচনা। ফাঁকে ফাঁকে চলে যেতেন ঘাটশিলায়। অবসরযাপনে। ব্ন্ধুবান্ধবরা যেতেন সাহচর্যদানে। প্রমথনাথ বিশী , গজেন্দ্রকুমার মিত্র ,প্রবোধ কুমার সান্যাল, বাণী রায় , সুমথ নাথ ঘোষ এবং নীরদরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখ সাহিত্যিক। জমে উঠত আড্ডা।

তবে নির্জন এলাকায় একাকী ভ্রমণ প্রথম পছন্দ ছিল তাঁর। এঁদেল বেড়ের জঙ্গল, সুবর্ণরেখা, পাণ্ডবশীলা , কাছিমদহ, রাতমোহনা প্রভৃতি স্থানকে বাঙালির প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র নির্বাচনের হোতা ছিলেন তিনি। ফুলডুংরি পাহাড়ের পেছনে একটি পাথরের উপর বসে উপাসনা করতেন বিভূতিভূষণ। গৌরীকুঞ্জের সামনেও এমন একটা পাথরখণ্ড বড় প্রিয় ছিল লেখকের। কাছিমখোলের মতো আকারের এই পাথর টির নাম দিয়েছিলেন ‘কর্মকূট’। তাঁর বাড়ির লাগোয়া পথটির নাম লোক মুখে মুখে ‘অপুর পথ ‘ অভিধা পেয়ে যায় ।

ইছামতী উপন্যাসের জন্য মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে (১৯৫১) তাঁকে সম্মানিত করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দৈবে আস্থাশীল এই মানুষটি লিখেছিলেন একদিন, মরণের ডংকা বাজে। ব্ন্ধু বান্ধবদের কাছে বলতেন নিজের আয়ু ফুরিয়ে আসার গল্প। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে লিখে গেছেন জীবনের শেষ গল্প -যার শিরোনাম ‘শেষ লেখা’।

- Advertisement -
Latest news
Related news