Tuesday, May 21, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১১৫।। সৈয়দ মুজতবা আলী ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

সাহিত্যিক
সৈয়দ মুজতবা আলী বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক প্রবীণ সাহিত্যিক মুখোমুখি হন নবীন বিখ্যাত ‘শংকর’-এর। শঙ্কর সেই সাক্ষাতের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন আমার হাত চেপে ধরে আলী সায়েব বললেন ,”শংকর, মনে হচ্ছে স্মৃতি লোপ পাচ্ছে। তুমি একবার ‘সঞ্চয়িতা’ খানা ধরতো – ব্যাপারটা একটু খুঁটিয়ে দেখি।” তাঁর ক্লান্ত মলিন মুখে হঠাত্‍ হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল।
সেদিন যে আলি সায়েব একবারও না থেমে নির্ভুল ভাবে কবিগুরুর ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ ‘ আবৃত্তি করেছিলেন তিনি প্রখ্যাত রসসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী (জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ – মৃত্যু ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪)।

সর্বগুণান্বিত এই বাঙালি মনীষী ছিলেন বহুভাষাবিদ, সার্থক সাহিত্যিক। জন্মেছিলেন সিলেটের করিমগঞ্জে। বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী ছিলেন সরকারি চাকুরে। ভূমি দপ্তরের সাব -রেজিস্ট্রার। মা – আমাতুল মান্নান খাতুন ছিলেন আটপৌরে গৃহবধূ। গ্রামের স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর মুজতবাকে ভর্তি করানো হয় শান্তিনিকেতনে। ১৯২১ সালে। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম যুগের আশ্রমিক ছাত্র। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। আজীবন রাবীন্দ্রিক সাংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করেছেন।

বিশ্বভারতীর স্নাতক হিসেবে অর্জন করেছিলেন নন্দলাল বসু অঙ্কিত এবং আচার্য্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাক্ষরিত শংসাপত্র। পড়েছেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর হুমবল্ট স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান জার্মানের বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। অর্জন করেন পি. এইচ. ডি. ও ডি. ফিল. (১৯৩২) ডিগ্রি। পরে কায়রোতে ‘আল আজহার’ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিন্স আগা খানের আর্থিক সহায়তায় উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন।

নানা পেশায় আজীবন ভ্রমণ করেছেন আলী সাহেব। কাবুলে শিক্ষা দপ্তরের অধীনে তিন বছর শিক্ষকতা করেছেন। বরোদার মহারাজা সয়াজী রাওয়ের আমন্ত্রণে বরোদা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। পাকিস্তানের আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেছেন। অধ্যক্ষ হওয়ার আগে চার বছর কাটান কলকাতা শহরে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস বিভাগে আংশিক সময়ের প্রভাষক ছিলেন কিছুদিন। তারপর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেসনস (ICCR ) এর সচিব পদে যোগ দেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেন।

চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে কাটান শান্তিনিকেতনে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে যোগ দেন ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট। কাজ করেন ১৯৬৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত । প্রথাগত পাঠদান পদ্ধতি ও শৃংখলাপরায়ণ জীবনযাপন না-পসন্দ ছিল তাঁর। তৎকালীন উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে মতান্তর রূপ নেয় মনান্তরে। তাঁর বোহেমিয়ান জীবন যাপন ও ক্লাসে অনিয়মিত উপস্থিতির কারণে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। শান্তিনিকেতনের বাসা ছেড়ে চলে আসেন বোলপুরের নিচুপট্টিতে। আবদুর রউফের বাড়িতে। এই সময় দর্শনার্থীরা দেখা করতে এলে বিরক্ত মুজতবা দরজা খুলে নিজেই বলতেন – ‘আলী সাহেব তো ঘরে নেই’। রবি-হারা শান্তিনিকেতন সম্পর্কে চিঠিতে লিখতেন ‘শ্মশান, শান্তিনিকেতন’।

সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে ১৯৬৫ সাল । চাকরি চলে যায়। এরপর ভারত -পাক যুদ্ধের ঘূর্ণাবর্তে মুজতবা পুলিশি হেনস্তার মুখোমুখি হন। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর তাঁকে পাকিস্তানের গুপ্তচর সন্দেহে কয়েকবার জেরা করে । বহু ভাষাবিদ আলী সাহেব পনেরোটি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সংস্কৃত, ইংরেজি, জার্মানী , ইটালী , ফরাসী ভাষা সহ এদেশের নানা আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর গভীর দখল ছিল যার প্রক্ষেপণ হয় ,তাঁর রচনাবলিতে। ত্রিশখানি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ভ্রমণ -সাহিত্য ‘দেশে বিদেশে’। বাংলার সারস্বত সমাজে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি, এই রচনার সুবাদে। অসাধারণ ‘সেন্স অফ হিউমার’ তাঁকে বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণের সাথে পাংক্তেয় করেছে ।

সৈয়দ মুজতবা আলীর গ্রন্থগুলি হল – দেশে বিদেশে (১৯৪৯), জলে -ডাঙ্গায় (১৯৬০), ময়ূরকন্ঠী (১৯৫২) , চাচাকাহিনী (১৯৫৯), পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা (১৩৬৩), চতুরঙ্গ (১৩৬৭) , শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৬৮), ভবঘুরে ও অন্যান্য (১৩৬৯), শ্রেষ্ঠ রম্য রচনা (১৩৫৯) ,টুনি মেম (১৩৭০), প্রেম (১৩৭২), বড়বাবু (১৩৭২) ,রাজা- উজির (১৩৭৬), হিটলার (১৩৭৭) ও মুসাফির (১৩৭৮) ইত্যাদি। রচনা করেছেন চারখানি অনুপম উপন্যাস -অবিশ্বাস্য (১৯৫৩), শবনম (১৯৬১), শহর ইয়ার (১৯৬৯) এবং তুলনাহীনা (১৯৭৪)।

কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসে এক বিশ্বজনীন মানবতাবোধের মন্ত্রে দীক্ষিত হন মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় ছাত্রের প্রতিভার পরিচয় পেয়েছেন তখনই। ১৯২২ সালে বিশ্বভারতী সম্মিলনীতে আঠারো বছরের শিক্ষার্থী একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন । বিষয় ছিল -‘ইদ উৎসব’। এই প্রবন্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন গুরুদেবসহ সমবেত বুধমন্ডলী। রবীন্দ্র আবহে আজীবন মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে গেছেন আলী সাহেব। ছাত্র মুজতবা শান্তিনিকেতন ত্যাগের সময় গুরুদেবকে কথা দেন -‘বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয়, তবে ডাকলেই আমি আসব। যা দেবেন হাত পেতে নেব।’ কথা রেখেছিলেন। পত্নী রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে এসেছিলেন ফিরে। যোগ দিয়েছিলেন ইসলামের ইতিহাস পড়ানোর কাজে। নিজের সন্তান ফিরোজকে ভর্তি করেছিলেন এখানেই ।পাঠভবনে। থাকতেন ৪৫ পল্লীর কোয়ার্টারে। এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল অন্য হাতে পোষ্য এলশেশিয়ন ‘মাস্টার’ -এর চেন ধরে রাজকীয় পদচারণায় ঘুরে বেড়াতেন পথে -প্রান্তরে। খ্যাতির মধ্যগগনে আচম্বিতে বিড়ম্বনা নেমে আসে জীবনে। রবীন্দ্রনাথহীন শান্তিনিকেতনের হতশ্রী আচরণে সখেদে লিখেছেন -“রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করার শক্তি আমাদের নেই” (‘রবির বিশ্বরূপ’-প্রবন্ধ )।

ভ্রমণকাহিনী , রম্যরচনা , কবিতা , অনুবাদ সাহিত্য লিখেছেন দেদার। সমসাময়িক নানা পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে নামে – ছদ্মনামে। এত ছদ্মনাম আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের নেই। সত্যপীর , ওমর খৈয়াম, টেকচাঁদ, রায় পিথোরা, প্রিয়দর্শী। যখন যে নাম আলী সাহেবকে সম্মোহিত করেছে, তখন সে নামে লেখা প্রকাশ করেছেন ।

আজীবন সাহিত্য সাধনার জন্য নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন মুজতবা। তাঁর মধ্যে উল্লেযোগ্য তিনটি হল – নরসিংহ দাস পুরস্কার (১৯৪৯), আনন্দ পুরস্কার (১৯৬১) এবং সাম্প্রতিক অতীতে অর্জন করেছেন মরণোত্তর একুশে পদক (২০০৬)। বাংলাদেশের মাটিতে ঢাকা শহরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন রসসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ।★

- Advertisement -
Latest news
Related news