জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ জৈন মন্দির, জিনশহর
(খড়গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)আজকের জার্ণাল কোন হিন্দু মন্দির নয়, একটি জৈন মন্দিরের আখ্যান নিয়ে। জেলার একমাত্র প্রাচীন জৈন মন্দির এটি।
মেদিনীপুর নগরীর দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁয়ে আছে চির প্রবাহিনী কংসাবতী। সেই নদীর সামান্য নিম্নস্রোতে, নদীর দক্ষিণ তীরে একটি গ্রাম—জিনশহর। সেই গ্রামের একটি সুপ্রাচীন মন্দিরকে নিয়ে এই উপাখ্যান।
সুদূর অতীত কাল থেকে ভারতীয়দের জীবন যাপন হিন্দু, জৈন এবং বৌদ্ধধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে। জৈনধর্ম বিকশিত হয়েছিল আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পূর্বে। বৈদিক যুগের প্রতিস্পর্ধী হয়ে। বলা হয়, এই ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল প্রস্তরযুগের অবসানে, কৃষির সূচনার যুগে। ভগবান ঋষভদেব এই ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন।
ঋষভদেব জৈনধর্মের প্রবর্তক। সেকারণে, তাঁকে প্রথম তীর্থঙ্কর বা আদিনাথ বলা হয়। জৈনধর্মে মোট চব্বিশজন তীর্থঙ্কর। শেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর। খৃষ্টপূর্ব ৫৯৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
বিহার (বর্তমান ঝাড়খণ্ড)-এর নতুন গিরিডি জেলার পরেশনাথ (বা পার্শ্বনাথ) পাহাড়ে, যে পাহাড়কে ‘শমেত শিখর’ বলা হয়, সেই পাহাড়েই জৈনধর্মের ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে ২০ জনই মোক্ষলাভ করেছিলেন।
মানব সভ্যতার বিকাশ হয়েছে নদীকে আশ্রয় করে। দেখা যায়, জৈন সংস্কৃতির বহু অবশেষ ছড়িয়ে আছে ছোটনাগপুর মালভূমির এই প্রান্তদেশে কংসাবতী, শিলাবতী, দামোদর, সুবর্ণরেখা, দ্বারকেশ্বর ইত্যাদি ছোট-বড় অনেকগুলি নদীর দুই তীর জুড়ে। বহু মন্দির, বহু মূর্তি এখনও প্রত্যক্ষ করা যায় এই নদীগুলির অববাহিকায়।
কিন্তু অধিকাংশ মূর্তিই উদ্ধার করা হয়েছে নদী বা পুষ্করিণী থেকে। সেসকলের আবার অধিকাংশই ভাঙা বা বিকৃত। দুটি অভিমত আছে এই নিয়ে। একটি অভিমত হোল– ভিন্নধর্মের উদয়ে, স্থান ত্যাগ করবার সময়, জৈনরা নিজেরাই তাঁদের আরাধ্য দেবমূর্তিগুলি স্থানীয় জলাশয়ে বিসর্জন দিয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মতটিতে বলা হয়, জৈন বিরোধী ভিন্নধর্মীরাই মূর্তির অঙ্গছেদন করে জলাশয়ে নিক্ষেপ করেছিলেন।
বহু মূর্তিই সংগ্রহ করে বিভিন্ন সংগ্রহশালায় সুরক্ষিত আছে। তার বাইরে, আজও গ্রামে-গ্রামান্তরে, আদরে বা অনাদরে ছড়িয়ে আছে বহু মূর্তি। যেখানে আদরে অবস্থান করছে মূর্তিগুলি, দেখা যায়, ভিন্ন ভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় আচারে সেবাপূজা করা হচ্ছে সেগুলির। এমনও দেখা যায়, পুরুষমূর্তি নির্বিচারে দেবী হিসাবে পূজিত হয়ে চলেছেন।
কিন্তু মেদিনীপুর জেলায় মূর্তি ছাড়াও, দুটি মন্দির এখনও টিকে আছে, পুরাবিদেরা যেগুলিকে ‘জৈন মন্দির’ বলেই চিহ্নিত করেছেন। দুটিই কংসাবতীর তীরে অবস্থিত। একটি আছে বিনপুর থানার ডাইনটিকরী গ্রামে। অপরটি জিনশহরের এই মন্দির।
পণ্ডিতগণের অনুমান, যেসময় কংসাবতী নদী গভীর এবং নৌচলাচলের উপযোগী ছিল, দেশি-বিদেশী বণিকের দল এই নদীপথে বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে যাতায়াত করতেন। সেসময়েই নদীর দক্ষিণ তীরে ছোটখাটো একটি বন্দর বা গঞ্জের পত্তন হয়েছিল।
সেই কোন অতীতকালে সম্পন্ন ও বিশিষ্ট জৈন বণিকগণ অবস্থান করতেন এখানে। ধর্মাচরণের প্রয়োজনে তাঁরা একটি মন্দির গড়েছিলেন। তা থেকেই এখানে গড়ে ওঠা জনপদটির নাম হয়েছিল– জিনশহর।
বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে, ১৯৭৪ সালে, তৎকালীন রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের সচিব, মাননীয় পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয়, এই মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন। সেসময় মন্দিরে এক তীর্থঙ্করের মূর্তি দেখেছিলেন তিনি। ফুট আড়াই উচ্চতার মূর্তিটি ছিল মাকড়া পাথরের। গর্ভগৃহের বেদীর উপর পদ্মাসনে উপবিষ্ট ধ্যানরত মূর্তি।
অনুমান করা হয়, মূর্তিটি চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীরের। এবং মূর্তিটি ভিন্ন কোনও স্থান থেকে এনে এখানে স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে সেই মূর্তি মন্দিরে উপস্থিত নাই। গর্ভগৃহের বেদী শূন্য।
বর্তমানে ভয়ানক রকম জীর্ণ সৌধটি দর্শক মাত্রকেই বিস্মিত করে তুলতে যতটা সক্ষম, এর প্রকৃত কাঠামো সম্পর্কে ধারণা করা ততটাই কঠিন। অতি সংক্ষেপে, মূল কয়েকটি বৈশিষ্টের উল্লেখ করছি আমরা।
মাকড়া পাথরের বড় বড় স্ল্যাব দিয়ে তৈরি সৌধটির ভূমি-নকশা থেকে বোঝা যায়, ইংরেজি এল আকারে গড়া হয়েছিল এটিকে। দেবালয়ের ক্ষেত্রে যা একটু বিরলই। পূর্বমুখী সৌধট পঞ্চ-রথ বিন্যস্ত শিখর দেউল হিসাবে গড়া হয়েছিল। ভিতরে প্রবেশ ও নির্গমণের জন্য একটিই দ্বারপথ ছিল এই পূর্বদিকে।
সামনে একটি জগমোহন ছিল। যার দু’দিকে দুটি কক্ষ ছিল। উত্তর দিকের কক্ষটি এখনও টিকে আছে। তখনও বাংলায় গম্বুজ নির্মাণের প্রচলন হয়নি। সবগুলি দ্বারপথ এবং কক্ষগুলির সিলিং গড়া হয়েছিল ‘লহরা’ বিন্যাস করে।
সঙ্কীর্ণ গর্ভগৃহকে চার দিক দিয়ে ঘেরা, একদ্বারী একটি প্রদক্ষিণ-পথ আছে। সেটি অতিক্রম করে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। সমগ্র মন্দিরটির নীচের অনেকখানি অংশই ভূমিগত হয়ে গিয়েছে। সেকারণে, গর্ভগৃহের অধিষ্ঠানবেদীটিও নিশ্চিহ্ন।
ভিতর কিংবা বাইরে পলেস্তারার চিহ্নটুকুও নাই। তবে, তা থেকেই দেওয়ালের রথ-বিন্যাস এবং ‘পা-ভাগে’র ভাঁজ বা ফোল্ডিংগুলি স্পষ্ট দেখা যায়।
মন্দিরের সিঁড়িটি এখনও টিকে থাকলেও, দ্বিতল অংশটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। তার কোন বিবরণ দেওয়ার বাস্তবতা নাই। তবে, মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গণে মন্দিরের চুড়ার বিশালাকার আমলকটি পড়ে আছে। সেটি থেকেই অনুমান করা যায়, মন্দিরটি আকারে বেশ বড়ই ছিল।
তেমন কোন অলঙ্করণ আজ আর দেখা যায় না। তবে—১. জগমোহনের উত্তর দিকের কক্ষের বাইরে, পূর্বদিকের দেওয়ালে জাফরিকাটা জানালার ওপরে, একটি পুরুষসিংহ মূর্তি; ২. উত্তর দিকের প্রদক্ষিণ-পথের দেওয়ালে একটি সিংহমুখ; ৩. এই মন্দির থেকে পাওয়া, জৈন তীর্থঙ্করদের ৬টি দণ্ডায়মান মূর্তি খোদাই করা গ্রানাইট পাথরে নির্মিত, একটি দ্বারফলক; ৪. মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গণে রক্ষিত বড়মাপের একটি খাঁজকাটা আমলক ইত্যাদি থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, জিনশহর গ্রামের এই সৌধটি জৈন মন্দিরই ছিল।
কালের আঘাতে মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একথা স্বীকার করতেই হয়। পাশাপাশি, মন্দির ধ্বংসের অন্য একটি কারণও এখানে জানিয়ে রাখা দরকার। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে, জিনশহর-বালিহাটি এলাকায় একটি নীলকুঠি গড়ে উঠেছিল। কুঠিটি নির্মিত হয়েছিল জৈনমন্দির ভেঙে তার পাথর দিয়ে। কেবল কুঠিই নয়, মন্দিরের লাগোয়া পূর্বদিকের ‘ভোগলা পুকুর’ নামের দীঘির বিশালাকার ঘাটটিও সেই পাথর দিয়ে গড়া হয়েছিল। কালের আঘাত যত না পড়েছে এই মন্দিরে, মানুষের লোভ আর অবিবেচনার আঘাত তার চেয়েও বেশি সইতে হয়েছে জেলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যের এই স্মৃতিসৌধটিকে।
তবুও, ক্ষুধিত পাষাণ সৌধের এখনও যে অবশেষ টিকে আছে, সেটিও বিস্ময়ে দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকবার মতো।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী নিমাই চন্দ্র বাকলী, মন্দিরের বর্তমান স্বত্ত্বাধিকারী—জিনশহর।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ মাননীয় শ্রী সুশীল কুমার বর্মণ, ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ (গার্লস উইং)-এর এসোসিয়েট প্রফেসর এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ—ঝাড়গ্রাম।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর শহর থেকে বীরেন্দ্র সেতুতে নদী পার হয়েই, পূর্বমুখে কিমি দুই দূরে, জিনশহর গ্রামের পূর্বপ্রান্তে, বাকলী বংশের বাস্তুতে এই মন্দির।