Monday, May 20, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৫৬।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
শ্রীধরনাথ মন্দির,
খড়ার (ঘাটাল, মেদিনীপুর)মন্দিরময় নগরী খড়ার। কাঁসাশিল্পের অগ্রগণ্য এক প্রাচীন শহর। বিশ শতকের প্রথম বছর, ১৯০১ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, মেদিনীপুর জেলায় শহরের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭টি। খড়ার ছিল তার অন্যতম।
কাঁসাশিল্পের সুবাদেই সমৃদ্ধ হয়েছিল এই জনপদ। এই শিল্পের আকর্ষণে, বহু বহিরাগত পরিবার খড়ারে এসে বসত গড়েছিলেন। উৎপাদক, কর্মী, ব্যবসাদার, ফড়ে, দালাল—প্রমুখদের উপস্থিতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল।
জনসংখ্যা আর ব্যবসা যত বাড়ছিল, আনুপাতিক হারে অর্থনীতিও পুষ্ট হচ্ছিল তাল মিলিয়ে। দু’য়ের মিশেলে প্রথমে শহর এবং পরে, ইংরেজ শাসনে, পৌরসভা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল খড়ার।
সম্পন্ন ব্যবসায়ীদের বড় বড় অট্টালিকায় সেজে উঠেছিল ছোট্ট শহরটি। স্থায়ী কীর্তি রেখে যাওয়ার অভিলাষে, অনেক অর্থবান পরিবার দেবালয় নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে, আজও খড়ারের পাড়ায় পাড়ায় অলিতে-গলিতে প্রাচীন দেবালয় দেখা যায়। এমনকি, তেরো-চুড়া মন্দিরও দেখা যায় এখানে।
আজ সব মন্দিরের অস্তিত্ব আর সমান নাই। কোনটি সম্পূর্ণ অবলুপ্ত, কোনটি জীর্ণ। কোনটি সংস্কার করে নেওয়া হয়েছে। কোনটি হয়ত অর্ধভগ্ন, দেবতা নাই মন্দিরে। লোকচক্ষুর সামনেই তিলে তিলে অবলুপ্ত হয়ে চলেছে সৌধটি।
কোনও মন্দির আবার জীর্ণ, অর্ধ-ভগ্ন। কিন্তু দেবতা অধিষ্ঠিত আছেন গর্ভগৃহে। সেবাপূজাও পূর্বাপর বহাল আছে রীতি অনুযায়ী। তেমনই এক মন্দিরের কথা আজকের জার্ণালে।
খড়ারে কাঁসাশিল্পের যখন স্বর্ণযুগ, সেসময় অগ্রগণ্য ব্যবসায়ীদের অন্যতম একজন ছিলেন জনৈক গুরুদাস সাঁতরা। চার-চারটি কারখানা ছিল গুরুদাসের। বড় মাপের একজন উৎপাদক হিসাবে নামডাক ছিল তাঁর।
গরু-মহিষের পিঠে বা গাড়িতে চাপিয়ে ঘাটাল পর্যন্ত। পরে, ভাউল্যা নৌকায় রূপনারায়ণ আর হুগলী নদীপথে কলকাতায় মাল পাঠাতেন। পরে, হোর মিলার কোম্পানির স্টিমার চলাচল শুরু হলে, অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মতো, ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল গুরুদাসের ব্যবসাও।
প্রাসাদের তূল্য বিশাল অট্টালিকা গড়েছিলেন গুরুদাস। তারই চৌহদ্দির ভিতরের অঙ্গণে, মন্দির গড়েছিলেন কুলদেবতা শ্রীধরনাথ জীউর।
শাস্ত্র অনুসারে, শ্রীধর হলেন বিষ্ণু, ‘লক্ষ্মীধারক’। বনমালা ভূষিত শালগ্রাম শিলা বিশেষ। তেমনই একটি শালগ্রামেই তিনি এখানে পূজিত হন।
মন্দিরে কোন প্রতিষ্ঠা-লিপি নাই। পূর্ববর্তী পুরাবিদ্গণ বলেছেন, মন্দিরটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি কোন সময়ে নির্মিত হয়ে থাকবে। কিন্তু সেবাইত সাঁতরা বংশের অভিমত, এই মন্দির শ’তিনেক বছরের পুরাণো। সমীক্ষাকালে আমরা এই বংশের আট-পুরুষের বংশলতিকাই পেয়েছি।
যাইহোক, ইটের তৈরি নব-রত্ন মন্দিরটি পূর্বমুখী। দুটি তলেই মন্দিরের মাথায় সমতল ছাউনি দেওয়া। ফলে, কার্ণিশগুলি সরলরৈখিক। গর্ভগৃহটি দালানের গড়ন মনে হয়। প্রথম তলে, সামনের অলিন্দে খিলানের তিনটি দ্বারপথ। স্তম্ভগুলি বিশালাকার। খিলানের নীচের প্রান্তে শেষ না হয়ে, একেবারে ছাউনি পর্যন্ত বিস্তার সেগুলির। প্রথমেই করিন্থিয়াম রীতিকে স্মরণ করায়।
রত্নগুলিতে রথ-বিন্যাস এবং পীঢ়-ভাগ করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় রত্নে ত্রি-রথ এবং বাকিগুলিতে পঞ্চ-রথ। শীর্ষক অংশগুলি বিলুপ্ত। বেঁকি, আমলক, খাপুরি, কলস, চক্র কিছুই আর অবশিষ্ট নাই, কিছুই।
চারদিকে ইট বের করা আজকের জরাজীর্ণ মন্দিরটি একদিন মোড়া ছিল মসৃণ পঙ্খের প্রলেপে। উৎকৃষ্ট ভাস্কর্যের জন্য একদিন খ্যাতিমান ছিল মন্দিরটি। সেসবের অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
তবে, সামনের দেওয়ালে, প্রথম কার্ণিশের নীচে সমান্তরাল এক সারিতে তিনটি প্যানেল দেখা যায়। পুরু শ্যাওলার আস্তরণের তলায় ঢাকা পড়া, এক সারি দেব-দ্বিজ মূর্তি। বা-রিলিফ রীতির কাজ সেগুলি। বিস্ময়ের ব্যাপার হোল, মন্দিরে গর্ভগৃহের লাগোয়া কক্ষটি কালী-দালান নামে চিহ্নিত। ঘটা করে কালীপূজা হয় সেটিতে। এক সময় বিশেষ আড়ম্বরের সাথে দুর্গাপূজাও হোত এখানে। বিষ্ণু মন্দিরে কবে থেকে কিংবা কোন কারণে শাক্ত-রীতিতে পূজার প্রচলন করা হয়েছিল, তা আজ আর সাঁতরাবংশ স্মরণ করতে পারেন না।
সম্পূর্ণ মন্দিরটি ভারি জ্বরাগ্রস্ত। শেষ নিদান লেখা হয়ে গিয়েছে এর ললাট-লিপিতে। নাই আর অট্টালিকাটিও। কেবল মূল দেউড়ি, আর মাথায় ছাদবিহীন করিন্থিয়াম-রীতির কতকগুলি থাম এখনো আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে টিকে আছে, সাঁতরা বংশের অতীত গরিমার নীরব সাক্ষী হয়ে। সাক্ষাৎকারঃ শ্রী তারাপদ সাঁতরা, অ্যাডভোকেট– খড়ার। শ্রী দিলীপ নায়েক– খড়ার ও মেদিনীপুর শহর।
পথনির্দেশঃ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মভিটে বীরসিংহ গ্রামের লাগোয়া পূর্বে খড়ার। মেদিনীপুর, ঘাটাল, আরামবাগ শহর, কিংবা চন্দ্রকোণা রোড রেলস্টেশন থেকে খড়ার যাওয়া যায়।

- Advertisement -
Latest news
Related news