Monday, May 20, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৫৭ ।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশদুর্গা মন্দির, টুরেপাড়া
(শালবনি, পশ্চিম মেদিনীপুর)                    টুরেপাড়া গ্রামের একটি প্রাচীন জমিদার বংশের দুর্গা মন্দির নিয়ে এবারের জার্ণাল। মেদিনীপুর জেলাই নয়, বাংলারও অধিবাসী ছিল না বংশটি। আদিতে এঁরা ছিলেন রাজপুতানা এলাকার শোলাঙ্কি ক্ষত্রিয়।
১৪শ শতাব্দীতে দিল্লীর শাসক আলাউদ্দিন খিলজীর বারংবার সৌরাষ্ট্র-রাজপুতানা ইত্যাদি এলাকা আক্রমণের সময়, ধন, প্রাণ এবং স্বধর্ম রক্ষার প্রয়োজনে, বহু শোলাঙ্কি রাজপুত পরিবার, তীর্থদর্শনের অজুহাতে, দেশত্যাগী হয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের কয়েকটি অংশ পুরীতে জগন্নাথ দর্শন সেরে, মেদিনীপুর জেলায় ঢুকে পড়েন। তাঁদেরই বেশ কিছু শোলাঙ্কি পরিবার, মেদিনীপুর বা খড়গপুর শহর সহ এই জেলার দক্ষিণ এবং পশ্চিম এলাকায় কয়েক শ’ বছর ধরে, আজও স্থায়ী অধিবাসী হয়ে বসবাস করে আছেন।
টুরেপাড়া গ্রামের জমিদার বংশ তেমনই একটি শোলাঙ্কি বংশ। তবে, এই বংশের অতীত ইতিহাস বিষ্ণুপুর রাজবংশের সাথে এক সূতোয় গাঁথা। সেকারণে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে আমাদের।
বিষ্ণুপুর (বাঁকুড়া জেলায়) রাজবংশের প্রতিষ্ঠা দেড় হাজার বছরেরও আগে। ইং ৬৯৪ সালে জনৈক আদি মল্ল এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে, এই বংশের ৪৯তম রাজা হাম্বির মল্ল ( ইং ১৫৬৫ – ১৬২০) ছিলেন বিষ্ণুপুরের শ্রেষ্ঠতম রাজা। রাঢ়বাংলায় পাঠান আগ্রাসনের বিরূদ্ধে বহুবার যুদ্ধ করেছেন তিনি। হাম্বির ছিলেন প্রখর সামরিক জ্ঞানের অধিকারী। সেসময় বিষ্ণুপুর রাজ্যের চতুঃসীমায় অবস্থিত জামকুড়ি, বগড়ি, সিমলাপাল, ইন্দাস, রাইপুর, ধারাপাট, চন্দ্রকোণা, গড়বেতা ইত্যাদির সামন্ত রাজাদের সাথে, পূর্বকালের বিদ্বেষ দূর করে, মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
সেই সম্পর্কের সুবাদে, হাম্বিরের সময়কালে, আঞ্চলিক স্তরে, একটি কার্যকরী ‘মিত্রশক্তি’ গড়ে উঠেছিল। কোন একটি রাজ্যের সঙ্কট সৃষ্টি হলে, চুক্তি অনুসারে, অন্যেরা সামরিক শক্তি নিয়ে তার পাশে দাঁড়াতেন।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

একবার পাঠান বাহিনীর সাথে হাম্বিরের সেই মিত্র বাহিনীর যুদ্ধে, জয় সিংহ নামের এক সেনা সর্দারের মৃত্যু হয়। জয় সিংহ ছিলেন পূর্বোক্ত শোলাঙ্কি সম্প্রদায়ভুক্ত একজন ক্ষত্রিয় বীর।
নিহত জয় সিংহের পত্নী সেসময় আসন্ন প্রসবা। স্বামীর মৃত্যুসংবাদ শুনে, নিরাপত্তার কারণে, এক পরিচারিকার সাথে পালিয়ে গিয়ে, আত্মগোপন করতে হয়েছিল তাঁকে। জানা যায়, কিছুকাল পরে, পুত্রসন্তান জন্মালে, শিশুপুত্রের প্রাণরক্ষার তাগিদে, বিষ্ণুপুর এলাকা ছেড়ে, দক্ষিণের ভঞ্জভূম পরগণায় চলে এসেছিলেন তিনি।
সেসময়কালের অবস্থা এবং পদ্ধতি অনুযায়ী, নিজেদের সিংহ পদবী এবং পূর্বের শোলাঙ্কি বংশপরিচয় সম্পূর্ণ গোপন এবং ত্যাগ করে, স্থানীয় ‘দোলই’ পদবী গ্রহণ করতে হয়েছিল তাঁকে।
মেদিনীপুর শহরে নজরগঞ্জ মহল্লার জমিদার ‘জানাবংশ’, হবিবপুর মহল্লার জমিদার ‘দাসবংশ’, খড়গপুর শহরের কৌশল্যার জমিদার ‘নাটুয়াবংশ’, পটাশপুর থানার নৈপুরগড়ের জমিদার ‘কানুনগোবংশ’ প্রভৃতি জমিদার বংশগুলি আদিতে ছিল এরকমই শোলাঙ্কি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
দোলইবংশ আরও কিছুকাল পরে, ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার কিছু পূর্বে, নিজেদের জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভঞ্জভূমের জমিদার কর্ণোগড়ের রাজা এবং নাড়াজোলের রাজা—দুজনের কাছ থেকে সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। আজকের জঙ্গল মহলের শালবনি থানার, সেকালের ভঞ্জভূম পরগণায় জঙ্গল হাসিল করে নতুন একটি জনপদ বা গ্রামের পত্তন হয়েছিল দোলইদের হাতে। পরবর্তীকালে সেটিই ‘টুরেপাড়া’ (জে এল নং ৪২০) নামে, মৌজা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।
জমিদারী পত্তনের পর, দেবী দুর্গার জন্য, বিশালাকার একটি দালান মন্দির নির্মাণ করেছিলেন জমিদারবংশ। মহা আড়ম্বরে পূজার প্রচলন হয়েছিল দেবীর। জায়গীর সম্পত্তি দেওয়া হয়েছিল পুরোহিত, বাদ্যকর, কুমোর ইত্যাদি বংশগুলিকে।
জমিদার বংশের শেষ সাত পুরুষের বিবরণ আছে আমাদের হাতে। তা থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেবীর মন্দিরটি অতিশয় জীর্ণ। তবে, পূর্বের আড়ম্বর না থাকলেও, পূজাটি পূর্বাপর প্রচলিত আছে। পারিবারিক রীতির ঐতিহ্যকে মান্য করে, এক চালির প্রতিমা গড়া হয়। তাতে চার পুত্রকন্যা সহ সিংহবাহিনী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। দোলই বংশের গঙ্গেশ (সুফল) এবং কমলেশ—এই দুই সদস্যের ততপরতায়, পূজাটি অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। তবে, সেসময় অন্য শরিকেরাও সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
এছাড়া, আরও ৩টি পূজা হয় মন্দিরে—জন্মাষ্টমী, জিতাষ্টমী এবং সরস্বতী পূজা। জিতাষ্টমীর পূজাটি দোলইবংশের মহিলারাই করে থাকেন।
দেবী দুর্গার দালান মন্দিরটি ইটের তৈরি, পূর্বুমখী। পাদপীঠ অংশটি ফুট তিনেক উঁচু।
সাড়ে ১২ ফুট চওড়া আর উত্তর-দক্ষিণে ৩৮ ফুটের টানা বিস্তার—এমনই বিশাল এক অলিন্দ। তাতে খিলান-রীতির পাঁচটি উন্মুক্ত দ্বারপথ। দ্বারগুলি রচিত হয়েছে আটটি করে গুচ্ছ থাম বা স্তম্ভের সাহায্যে। অলিন্দের পিছনে একই রীতির থাম আর তিনটি খিলানের দ্বারযুক্ত গর্ভগৃহ। তার ডাইনে আর বামে দুটি পৃথক কক্ষ। সেবাপূজার কাজের জন্য।
নাটমন্দির, অলিন্দ এবং গর্ভগৃহ—সবগুলিরই সিলিং হয়েছে কড়ি আর বরগায়। সেকারণে, মন্দিরের কার্ণিশটি সরলরৈখিক। সামনের দেওয়ালে পাঁচটি খিলানের মাথা বরাবর আলসের উপর একটি করে অনুচ্চ স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের শীর্ষক বা চুড়াটি নির্মিত হয়েছিল মাঝখানের কেন্দ্রীয় স্তম্ভের উপর। দু’দিকে ব্যাদিত-বদন দুটি সিংহমূর্তি। কিন্তু মূল শীর্ষকটি এতখানিই জীর্ণ যে, কেবল বেঁকি এবং আমলকটি ছাড়া উপরের অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট নাই আর।
কেবল গর্ভগৃহ আর অলিন্দটিই প্রশস্ত আকারে নির্মিত হয়নি। সামনে প্রকাণ্ড একটি নাটমন্দিরও গড়া হয়েছিল। যার তুলনা সারা মেদিনীপুর জেলার ৮০০ থেকে ১,০০০ প্রাচীন মন্দিরের কোথাও নাই। অন্য কোনও জেলায় আছে কি না, অভিজ্ঞ সমীক্ষকেরাই আলোকপাত করতে পারবেন।
৪১ ফুট দৈর্ঘ্য আর সাড়ে ৩৯ ফুট প্রস্থ সেই নাট্মন্দিরের। মোট ৪ সারি স্তম্ভ। অর্থাৎ নাটমন্দিরের অভ্যন্তরে ডাইনে এবং বামেও দু’সারি করে অতিরক্ত স্তম্ভের সমাবেশ হয়েছে। তিন দিকেই পাঁচটি করে খিলানের দ্বার তাতে।
মন্দিরটিতে মোট ৩৬টি স্তম্ভ—৩২টি পূর্ণ-স্তম্ভ (পিলার) এবং ৪টি অর্ধ-স্তম্ভ (পিলাস্টার)। স্তম্ভগুলির গড়ন সম্পর্কেও সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। নাটমন্দিরের বহির্ভাগে ১৬টি একক স্তম্ভ। অভ্যন্তরের স্তম্ভগুলি ৪টি করে স্তম্ভের গুচ্ছ। আর, গর্ভগৃহ এবং অলিন্দে আটটি করে স্তম্ভের সমাহার দেখা যায়।
খিলানের বিস্তার সম্পর্কেও বলা যেতে পারে। এখানে খিলানের (দ্বারপথের) বিস্তার চোখে পড়বার মত। খিলানগুলির (দুটি স্তম্ভের মধ্যভাগের ব্যবধান) ৭ থেকে ৮ ফুট। কারিগরী প্রকৌশল সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা এর তাতপর্য অনুধাবন করতে পারবেন নিশ্চয়ই। সারা জেলায় এমন আর দুটি আমাদের চোখে পড়েনি।
একটি কথা অকপটে বলা যায়, বিশালাকার এই মন্দির সৌধের সাথে স্তম্ভ এবং খিলানগুলি বেশ মানানসই। চোখ পড়ামাত্রই মন্দিরটির রাজকীয় গড়ন সম্পর্কে বেশ সম্ভ্রম জাগে।
পরিতাপের বিষয়, এমন একটি ঐতিহাসিক সৌধ, যা এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পদ হিসাবে গৌরবের কারণ হতে পারত, সেটিকে রক্ষা করবার জন্য কোন উদ্যোগ নাই কোন স্তরেই।
পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠান উন্নয়ণ খাতে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তার সামান্য একটু অংশে মন্দিরটি সংস্কার করে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সকলের চোখের সামনেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে একটি মূল্যবান হেরিটেজ মনুমেন্ট।
ইতিহাস আর ভবিষত প্রজন্ম ক্ষমা করবে তো আমাদের?
সাক্ষাতকারঃ শ্রী গঙ্গেশ কুমার দোলই (সুফল), শ্রী কমলেশ দোলই—টুরেপাড়া।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর শহর থেকে ২০ কিমি উত্তরমুখে, বাঁকুড়াগামী পথের উপর, টুরেপাড়া স্টপেজ। এবার ১ কিমি পূর্বমুখে দোলইবংশের মন্দির।

- Advertisement -
Latest news
Related news