নিজস্ব সংবাদদাতা: মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বাঙালির জীবন্ত কিংবদন্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বাংলা সঙ্গীতের জগতে যে কাল রাত্রি শুরু হয়েছিল মধ্যরাতে তারই আরেক ছোবল যেন গিয়ে পৌছালো মুম্বাইতে। বাঙালির আরেক গর্বের সন্তান তথা ভারতীয় সঙ্গীত জগতের অনন্য প্রতিভা বাপি লাহিড়ি প্রয়াত হলেন। মঙ্গলবার মধ্যরাতে মুম্বইয়ের জুহুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মাত্র ৬৯ বছর বয়সেই মৃত্যু হল সঙ্গীত জগতের এই উজ্জ্বল প্রতিভার।
২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন বাপি লাহিড়ি। দীর্ঘ চিকিৎসার পর মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়িও ফেরেন। কিন্তু শরীরের বিভিন্ন অংশে গুরুতর সমস্যা শুরু হয়ে যায় তাঁর। ফলে এবছর জানুয়ারির মাঝামাঝি ফের হাসপাতালে যেতে হয় তাঁকে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, গত প্রায় একমাস তিনি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তারপর সোমবারই বাড়ি ফেরেন বাপ্পি। কিন্তু মঙ্গলবারই ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরিবারিক চিকিৎসক তাঁকে ফের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। মঙ্গলবার মধ্যরাতে সেই হাসপাতালেই তাঁর মৃত্যু হয়। ওই হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে ‘অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (OSA)’-তে আক্রান্ত হয়ে মুম্বইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় স্লিপ অ্যাপনিয়া এমন একটি ঘুমের অসুখ যাতে ব্যক্তির ঘুমানোর সময় শ্বাস নেওয়া ক্রমাগত বন্ধ হয়ে যায় ও পুনরায় শুরু হয়। অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া সাধারণ অবস্থা, যেখানে নাক থেকে শ্বাসনালীর মধ্যেকার শ্বাসপথের উপরিভাগের কোনও একটি অংশ অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষ নাক ডাকে। সাধারণ অবস্থায় এই অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বিপদজনক হওয়ার আগেই মানুষ ঘুমের ঘোরেই সচেতন হয়ে পড়েন, ঘুমের ঘোরেই পাশ ফেরেন বা ক্ষণিকসময়ের জন্য জেগে যান ফলে বিপদ ঘটার অনেক আগেই রেহাই মিলে। আর এভাবেই অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকেন। কিন্তু শরীর মারাত্মক দুর্বল বা অচেতন হয়ে পড়লে সেই স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া তখন কাল হয়ে যায় আর সেটাই হল শিল্পীর ক্ষেত্রে।
গত শতকের আটের দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জগতে পপ-ডিস্কো গানের যে জোয়ার এসেছিল তাঁর অন্যতম পুরোধা ছিলেন বাপি। ‘ডিস্কো ডান্সার’ (১৯৮২), ‘ডান্স ডান্স’ (১৯৮৭) হয়ে একের পর এক ছবিতে করা তাঁর সুর সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে আন্দোলিত করেছিল। সেই সময়ের এক প্রতিনিধি হিসেবে বাপি লাহিড়ীর অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে হবে। সংগীতের সমসাময়িকতা যে তাঁর নাড়ির স্পন্দনে তা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছিল ২০১১ সালে ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতে ‘উলালা’ গানের মধ্যে দিয়ে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বুঁদ করে রাখার কোন জাদুক্ষমতায় বলীয়ান তিনি। তবে কেবল পপ বা ডিস্কো নয়, নরম রোম্যান্টিক গানেও যে তিনি অনন্য তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল কেরিয়ারের শুরুতে ‘চলতে চলতে’ (১৯৭৬) ছবিতে বাপির করা সুর থেকেই।
১৯৭০ থেকে ৮০-এর দশকে হিন্দি ছায়াছবির জগতকে কার্যত শাসন করেছেন বাপি লাহিড়ি। ততদিনে বাবা-মার দেওয়া পোশাকি নাম আলোকেশ মুছে গিয়ে তাঁদের দেওয়া আদুরে ডাক নাম ‘বাপি’তেই খ্যাত তিনি। হিন্দি দুনিয়া অবশ্য ‘বাপ্পি’ বলেই ডাকত। বলিউডে ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘চলতে চলতে’, ‘শরাবি’র পাশাপাশি বাংলায় ‘অমর সঙ্গী’, ‘আশা ও ভালবাসা’, ‘আমার তুমি’, ‘অমর প্রেম’ প্রভৃতি ছবিতে সুর দিয়েছেন। গেয়েছেন বহু গান। ২০২০ সালে তাঁর শেষ গান ‘বাগি- ৩’ এর জন্য। কিশোর কুমার ছিলেন বাপ্পির তুতো মামা। বাবা অপরেশ লাহিড়ি ও মা বাঁশরী লাহিড়ি— দু’জনেই সঙ্গীত জগতের মানুষ ছিলেন। একমাত্র সন্তান বাপ্পিও ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। মা, বাবার কাছেই পান প্রথম গানের তালিম।
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বাপি। মাত্র ৩ বছর বয়সে তবলা বাদক হিসেবে কেরিয়ার শুরু। তারপর একে একে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসা। ২০২০ সালে ‘বাগী ৩’ ছবিতে ‘ভাঙ্কাস’ গানটিই ছিল তাঁর শেষ কাজ। মাঝের দীর্ঘ সময়ে সুরকার তো বটেই, কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও যে অবদান তিনি রেখেন গেলেন তা অবিস্মরণীয়। মঙ্গলবারের সন্ধ্যা কেড়ে নিয়েছিল প্রবাদপ্রতিম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চলে গেলেন বাপি লাহিড়ীও। সন্ধ্যা শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই বাপির শোক। যেন দ্বিতীয় হার্ট আ্যটাকে স্তম্ভিত বাঙালি।