মেদিনীপুর

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৯৪ ।। চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশ
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, মারকুণ্ডা
(নারায়ণগড় থানা, জেলা মেদিনীপুর)

উঁচু প্রাচীরে ঘেরা বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। তার ভিতর অতিথিশালা, আট-কোণা তুলসিমঞ্চ, গরুড়মূর্তি ইত্যাদি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নব-রত্ন রীতির একটি প্রাচীন মন্দির।
শ’দেড়েক বছর আয়ু হয়েছে মন্দিরটির। কিন্তু এরই মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতার পরিচয়। শহর নগর থেকে অনেকখানি দূরে। এমন প্রত্যন্ত এলাকায় কে গড়েছিলেন ঋজু গড়নের এই মন্দিরটি? তাঁর নামটি কী ছিল? তাঁর পরিচয় হারিয়ে গিয়েছে কালের জাবদা খাতা থেকে।
তবে, খাতায় লেখা আছে এক নিঃসন্তান রমণীর নাম— মাতঙ্গিনী দেবী। তাঁর সময়ে, তিনিই ছিলেন মন্দিরের স্বত্ত্বাধিকারী। বর্ধমানের অধিবাসী জনৈক বৈকুন্ঠনাথ মারিককে দত্তক নিয়েছিলেন তিনি। জীবনের অপরাহ্ন বেলায় মন্দির, দেবতার পূজার ভার, আর ১৪০০ বিঘা ভূসম্পত্তি বৈকুন্ঠনাথের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী।
বৈকুন্ঠনাথের চারজন পুত্র। বিলাসিতার উপকরণ সন্ধানে যতটা যত্নবান ছিলেন তাঁরা, সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমায় অমনোযোগী ছিলেন তার চেয়েও বেশি। তার ফলে, সূর্যাস্ত আইনে, সম্পত্তিগুলি নিলাম করে দিয়েছিল ইংরেজ সরকার।
সেই সঙ্কটের কালে, বৈকুন্ঠনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র যতীন্দ্রনাথ, জনৈক সত্যনাথ মারিকের হাতে দেবতার সেবাপূজার ভার তুলে দিয়েছিলেন।
সেই থেকে আরও একাধিক বার মন্দির পরিচালনার ভার হাত বদল হয়েছে। দেবতার স্থানান্তরও হয়েছে একাধিক বার। সত্যনাথের পর, তাঁর পুত্র গৌরকিশোর মারিক সেবাপূজার কাজ করেছেন। গৌরকিশোর যখন মেদিনীপুর শহরে উঠে গেলেন গ্রাম ছেড়ে, দেবতার ভার দিয়ে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথের পুত্র ভবানী শঙ্করের হাতে।
এক সময় দু’বার চুরি হয় মন্দিরে। উৎকন্ঠিত হয়ে, গৌরকিশোর বিগ্রহ মেদিনীপুর নিয়ে চলে যান। গৌরকিশোরের প্রয়াণের পর, তাঁর পত্নী গীতারানী সেবাপূজা চালাতেন। তিনি অশক্ত হয়ে পড়লে, গৌরকিশোরের সহোদর ভাই নিতাই কিশোর উদ্যোগী হয়ে, মারকুণ্ডায় ফিরিয়ে নিয়ে যান দেবতাকে।
মন্দির সংস্কার আর বড় আকারের যাগযজ্ঞ করে পুণঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেবতার। ভবানী শংকরের পুত্র বিনয় মারিক নিয়েছেন পরিচালনার ভার। বৈষয়িক দায় বহন করেন সুবীর মারিক, নিতাই কিশোর মারিক, বিনয় মারিক, জয়ন্ত মারিক এবং অচিন্ত মারিক প্রমুখ।
পূর্বকালে গোষ্ঠ পণ্ডা, পুলিন ঘোষাল, শচীন পাহাড়ী প্রমুখ পৌরহিত্য করেছেন মন্দিরে। বর্তমানে ভূজঙ্গ ঘোষাল নিযুক্ত আছেন। নিত্যপূজা সহ, সম্বৎসরের জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, রথযাত্রা, রাসযাত্রা, মকর, চাঁচর আর দোল ইত্যাদি পার্বণগুলি তাঁরই পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া, বাসন্তী পূজা হয় এখানে। এখানে এই পূজার বৈশিষ্ট হোল, মূর্তি গড়ে পূজা নয়। এমনকি ঘটেও নয়। পূজাটি হয় পটে। শোলার পটে দেবীর মূর্তি এঁকে। পট আঁকবার কাজটি করেন নারায়ণগড় থানারই একটি শোলাশিল্পী পরিবার। একেবারে প্রথম দিন থেকেই এই ঐতিহ্য বজায় আছে মারিক বংশে।প্রতিষ্ঠালিপি অনুসারে, ইং ১৮৭৯ সালে নির্মিত হয়েছিল মন্দিরটি। উঁচু পাদপীঠ। তার উপর একটি প্রদক্ষিণ পথ। মন্দিরটি পূর্বমুখী। কিন্তু পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ— অলিন্দ গড়া হয়েছে তিন দিকেই। প্রতিটি অলিন্দেই খিলানের তিনটি করে দ্বারপথ। আটটি করে গুচ্ছ-রীতির থাম। মনোরম সৌন্দর্য ফুটেছে একারণে।
অলিন্দগুলির সিলিং হয়েছে টানা-খিলানে। দুটি গর্ভগৃহেই চারটি করে অর্ধ-খিলানের সিলিং।
এই মন্দিরের আর একটি বৈশিষ্ট হোল রত্নগুলির গড়ন। রত্নগুলির বাঢ় অংশের গড়নে বেশি রকম উচ্চতা দেখা যায়। রত্নগুলিতে কলিঙ্গশৈলীতে রথ-বিভাজন এবং পীঢ়-ভাগ করা।
মন্দিরে অলঙ্করণ অতি সামান্য। টেরাকোটার ব্যবহার নাই। স্টাকো-রীতির সামান্য কাজ দেখা যায়। ভিনিশীয় রীতির দু’জোড়া প্রতিকৃতি দরজা, চারদিকের কার্ণিশের নীচে পারাবতশ্রেণী, দ্বিতীয় তলের সামনের কার্ণিশের নীচে মুখব্যাদান রত পরস্পর মুখোমুখী দুটি ব্যাঘ্র—এইমাত্র।
বড় আকারের একটি তুলসিমঞ্চ আছে এখানে। মঞ্চটি একটু বিরল রীতির। আট-কোণা করে নির্মিত হয়েছে মঞ্চটি।
বিশেষ উল্লেখের বিষয় হোল, এই মন্দিরের দরজার দুটি পাল্লা। উৎকৃষ্ট দারু-তক্ষণের দৃষ্টান্ত এটি। ফুলকারি নকশার ঘেরাটোপের ভিতর, দশটি চতুষ্কোণ ব্লক। রাধাকৃষ্ণ, বীণাবাদনরত মহাদেব, সন্তান কোলে জননী, অশোক কাননে বন্দিনী সীতা ইত্যাদির মোটিফ।
শহর, নগর বা কোন ব্যস্ত জনপদ থেকে অনেক দূরে এই মন্দির। সচরাচর বহিরাগত কেউ পৌঁছন না এখানে। কিন্তু মন্দিরটি এমন সুদর্শন, একবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতে হয়।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী বিনয় মারিক—মারকুণ্ডা। শ্রী অচিন্ত মারিক—মেদিনীপুর শহর।সমীক্ষা সঙ্গীঃ শ্রী শুদ্ধসত্ত্ব মান্না, শিক্ষক—মেদিনীপুর শহর।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর কিংবা খড়গপুর শহর থেকে কেশিয়াড়ি গামী পথে খাজরা। সেখান থেকে পূর্বমুখে ৭ কিমি উজিয়ে মারকুণ্ডা গ্রাম। এছাড়াও, খড়গপুর থেকে দক্ষিণে বালেশ্বরমুখী পথের নারায়ণগড়। সেখান থেকে ১২ কিমি পশ্চিমে এই গ্রাম।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

1 year ago