শিল্প সাহিত্য

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১৯১।। চিন্ময় দাশ

Published by
KGP Desk

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
চিন্ময় দাশমদনগোপাল মন্দির, সামাট
(দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর) পূর্বকালের চেতুয়া পরগণার (বর্তমানে দাসপুর থানা) একেবারে পশ্চিম প্রান্তের একটি বিশিষ্ট জনপদ – নাড়াজোল। ৬০০ বছরেরও বেশি আগে, জনৈক উদয় নারায়ণ ঘোষ সেখানে একটি রাজবংশের পত্তন করেছিলেন। সময় ছিল বাংলা ৮২০ সন বা ইং ১৪১৩ সাল। বর্তমানে সেই বংশের ২১ তম প্রজন্ম নাড়াজোলে বসবাস করে আছেন। দীর্ঘ ৬০০ বছর সময়কালে মেদিনীপুর জেলার সমাজ জীবনে বহুতর অবদান রেখেছে এই রাজবংশ। এই নিবন্ধের সীমিত পরিসরে সেসব বিবরণ দেওয়ার অবকাশ নাই। প্রসঙ্গক্রমে দুটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে।

১. বাংলার নবাব দরবার থেকে এই রাজবংশের ৫ম রাজা কার্ত্তিকরাম ঘোষ ‘রায়’ এবং ৮ম রাজা বলবন্ত রায় ‘খান’ খেতাব পেয়েছিলেন। তখন থেকে রাজবংশটি ‘খান’ পদবীতে পরিচিত হয়ে আছে।
২. বংশের পঞ্চদশ রাজা ছিলেন মোহনলাল খান (শাসনকাল ইং ১৮৩০ সাল পর্যন্ত)। অনেক কীর্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম হোল, সামাট গ্রামে একটি দেবালয় প্রতিষ্ঠা। কংসাবতী নদীর কূলে মনোরম পরিবেশে বড় মাপের মন্দিরটি গড়ে, চন্দ্রকোণা নগরীর রামানুজ সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মোহনলাল।
‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক যোগেশ চন্দ্র বসু মহাশয় বলেছেন—“চন্দ্রকোণায় রমোপাসক সম্প্রদায়ের বড়, মধ্যম ও ছোট অস্থল নামে তিনটি মঠ আছে।“ বর্তমানেও এই মঠই সামাট গ্রামের মন্দিরটির পরিচালক।
মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, বারাণসী, বৃন্দাবন থেকে সাধুসন্তদের আনিয়ে, বিপুল সমারোহে উদবোধন করা হয়েছিল। মোহনলাল খানের পৌত্র মহেন্দ্রলাল তাঁর ‘THE HISTORY OF MIDNAPORE RAJ’ (প্রকাশক—CALCUTTA : THAKER SPINK CO.) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বাং ১২৩৫ সনে সামাট গ্রামের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং উদবোধনে প্রায় ১ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলকেও প্রতিষ্ঠার সময়কাল ১৭৫০ শকাব্দ ও বাংলা ১২৩৫ সনের উল্লেখ আছে।
মন্দিরের মূল বিগ্রহ মদন গোপাল। একটি দারু-বিগ্রহে তাঁর পূজা হয়। এছাড়া, পার্শ্বদেবতা আছেন—শ্রীরাধিকা, রামচন্দ্র-সীতাদেবী, হনুমান, শ্যামসুন্দর, রাধাকৃষ্ণ, মদন মোহন এবং নাড়ুগোপাল আছেন সিংহাসনে।
পূর্বকালে চন্দ্রকোণার রামানুজ আশ্রম, মন্দির পরিচালনার সাথে সাথে, মন্দিরে পৌরহিত্যও করত। কিছুকাল পূর্বে এই ধারাবাহিক প্রথা বদল করা হয়েছে।  সামাট গ্রামের অধিবাসী জনৈক মহাদেব ভট্টাচার্য্যকে প্রথমবার পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। জীবনাবসান পর্যন্ত তিনি মন্দিরে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তাঁর পুত্র বাণীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য মন্দিরে পৌরহিত্য করছেন।
অন্নভোগ সহ নিত্যপূজা হয় দেবতার। এছাড়া, সম্বৎসরে ঝুলনোৎসব, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, রাস উৎসব, মকর এবং দোল উৎসব উদযাপন করা হয় বিশেষ সমারোহের সাথে।
সামাটের গ্রামবাসীরাও আসেন পূজা নিয়ে। কেবল তাই নয়। উল্লেখ করবার মত বিষয় হোল, সামাট গ্রামে প্রতিটি পরিবারের সমস্ত শুভ অনুষ্ঠানই এই মন্দিরে এসেই আয়োজিত হয়।
উঁচু প্রাচীরে ঘেরা একটি প্রাঙ্গণের ভিতর অবস্থিত মদনগোপালের এই মন্দিরটি দালান-রীতিতে নির্মিত। ইটের তৈরি দক্ষিণমুখী সৌধটি বেশ বড় মাপের। সাড়ে ৪৬ ফুট বিস্তার এই মন্দিরের। সামনে একটি নাট্মন্দির আছে, টিনের ছাউনি দেওয়া।
মন্দিরে ২টি অলিন্দ। সামনের অলিন্দে পাঁচটি দ্বারপথ। পিছনের আবৃত অলিন্দ এবং গর্ভগৃহটি একদ্বারী। সবগুলি দ্বারপথ এবং তিনটি অংশের সিলিং গড়া হয়েছে খিলান-রীতিতে। বাইরে মন্দিরের ছাউনি সমতল। ফলে, কার্ণিশগুলি সরলরৈখিক।
টেরাকোটা, স্টাকো এবং পঙ্খ—তিন রীতিতেই অলঙ্করণ হয়েছে মন্দিরটিতে। টেরাকোটার ফলকগুলি বেশ বড় আকারের। যা সচরাচর দেখা যায় না।
ফলকের মোটিফ দশাবতার, অনুজ লক্ষ্মণ সহ সিংহাসনে আসীন রামচন্দ্র ও সীতাদেবী, রাবণরাজা, ঐরাবত-বাহন দেবরাজ ইন্দ্র, মহাকালী, দেবী দুর্গা, ত্রিভঙ্গমুরারী শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি। ফলকগুলি সুদর্শন, কিন্তু বর্তমানে ভারি জীর্ণ।
স্টাকো এবং পঙ্খের কাজ করা হয়েছে দ্বিতীয় অলিন্দ এবং গর্ভগৃহে প্রবেশের দরজার দু’পাশে। আছে মনোরম ফুলকারি নক্সার কাজও।  
বড় মাপের একটি রাসমঞ্চ ছিল এই মন্দিরের। উঁচু ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, নব-রত্ন রীতির সৌধ। পঙ্খের ফুলকারি নকশা ছিল মঞ্চে। বহুকাল পরিত্যক্ত মঞ্চটি অব্যবহারে, অনাদরে আর অবহেলায় ধংস হতে বসেছে।
সাধ থাকলেও, মন্দির আর রাসমঞ্চ সংস্কারের সাধ্য নাই অস্থল বা পুরোহিত ঠাকুরের। সরকার কিংবা অসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে, টেরাকোটা মণ্ডিত সৌধটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
ভারি মনোরম পরিবেশে, শ্যামল সবুজে মোড়া এলাকা। চিরপ্রবাহিনী কংসাবতী বয়ে চলেছে পাশ দিয়ে। নদীর নির্জন উঁচু পাড় বাইকিংয়ের আদর্শ স্থান। উপযুক্ত উদ্যোগ থাকলে, পর্যটন ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তোলা যায় এটিকে। প্রয়োজন কেবল পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসবার।
সাক্ষাৎকারঃ শ্রী সন্দীপ খান—নাড়াজোল রাজবাড়ি।
সর্বশ্রী বাণীশঙ্কর ভট্টাচার্য্য, সুবীর ভট্টাচার্য্য, মোহন চন্দ্র মণ্ডল, বিশ্বজিৎ রাণা, সমীর জানা—সামাট।
পথনির্দেশঃ মেদিনীপুর শহর থেকে নাড়াজোল হয়ে ঘাটাল গামী পথের উপর সামাট গ্রাম। এছাড়া, পাঁশকুড়া-ঘাটাল রাস্তার বকুলতলা থেকে নাড়াজোলগামী রাস্তায় সামাট। বাস রাস্তা থেকে কিমি দুই দূরে এই মন্দির।

Recent Posts

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৯ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, প্রজাবাড় (ময়না, পূর্ব মেদিনীপুর) যত দূর চোখ যায়, সবজি…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের  জার্ণাল- ২০৮ চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী দামোদরজীউ মন্দির, হাসিমপুর (কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর) মেদিনীপুর জেলার…

11 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৭।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শিব মন্দির, মিত্রসেনপুর (চন্দ্রকোণা, পশ্চিম মেদিনীপুর)বহুকালের প্রাচীন নগরী চন্দ্রকোণা। ভানবংশ,…

11 months ago

Templ Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ২০৬।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, শ্রীরামপুর (সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর) জমিদারী গড়েছিলেন বটে, বৈষয়িক ছিলেন…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল- ২০৫।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণমন্দিরের জার্ণাল চিন্ময় দাশ শ্রীশ্রী রসিকনাগর জীউ মন্দির, জয়ন্তীপুর (চন্দ্রকোণা শহর) মন্দির নগরী চন্দ্রকোণা। এর…

12 months ago

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-২০৪।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল— ২০৪ চিন্ময় দাশবিষ্ণু মন্দির, মার্কণ্ডপুর (পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর) রূপনারায়ণ নদ—মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের…

12 months ago